বর্তমানে বাংলাদেশে তিনটি ভাষায় শিক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত। সাধারণ শিক্ষা যেমন প্রাথমিক বিদ্যালয় উচ্চবিদ্যালয় এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে বাংলা ভাষায় পাঠ দান পদ্ধতি এবং আরো একটি পদ্ধতি হচেছ মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে আরবি ভাষাকে বাংলা ভাষার চাইতেও বেশী গুরত্ব দেয়া হয়। এবং আরবি ভাষাতেই পাঠ দান পদ্ধতি চালু, বই পুস্তুক সবকিছু আরবি ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। আবার অন্যদিকে আরো একটি ভাষায় শিক্ষা দান অব্যাহত সেটা হচ্ছে ইংরেজী। বাংলাদেশে মেডিক্যাল কলেজগুলো এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সহ সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুকিছু বিভাগ ইংরেজীতে পাঠ্য পুস্তুক, পরীক্ষা দেয়া সবকিছু পাঠ্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এছাড়াও রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন যায়গায় ইংলিশ মিডিয়াম এ পড়ালেখা চালু আছে। সেখানে শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে। এর পরে এখন শুরু হয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য যেখানে সরাসরি মোটা দাগের টাকার বিনিময়ে ভর্তি হয়। সেখানেও সম্পূর্ন ইংলিশ ভাষায় কোর্স কমপ্লিট করতে হয়। তাহলে দাড়ালো কি? ত্রিমুখি ভাষার শিক্ষা দান পদ্ধতির ফলে বাংলাদেশে এক খিচুড়ী মার্কা শিক্ষিত সমাজ তৈরী হচ্ছে। বিশ্বের অন্য কোথাও ৩/৪ ভাষায় শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে বলে মনে হয় না। দেশের এ অবস্থায় দেখা যায়।
যে ইংরেজি ভাষায় তার শিক্ষা জীবন সমাপ্তি করছে সে পাচেছ উচুদরের ভালো চাকুরী। আবার বাংলা ভাষায় যারা শিক্ষা জীবন শেষ করছে তাদের চাকুরীতে পদ না থাকায় বেকার জীবনের অসহনীয় জ্বালা যন্ত্রনায় ভূগতে হচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষায় যারা শিক্ষিত হচ্ছে তারা মসজিদের মূয়াজ্জিন, ইমামতীর চাকুরী এবং মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ছাড়া অন্য কিছুতে চাকুরী পাবার সম্ভাবনা নেই। সবচাইতে অবহেলীত হয় এই অংশটি।
এত গেল, ভাষাগত শিক্ষার পদ্ধতি দেখা যাক কোন টাতে কি ধারনের সুবিধা দেখা যায়, মেডিক্যেল এর বই পত্র ইংরেজি হওয়াতে যেমন সুবিধা রয়েছে ঠিক তেমনি অসুবিধাও রয়েছে অনেক ধারনের অসুবিধায় পড়তে হয়, অনেক কঠিন ইংরেজি ও বাংলা অর্থ খুজে পান না, ফলে রোগীদের ইংরেজি শব্দই বলে দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় রোগীরা পড়ে বিপাকে। মেডিকেল কলেজের বইপুস্তক ইংরেজীতে থাকার পাশাপাশী বাংলাতেও চালু হওয়া দরকার। অন্যদিকে মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে। একটি গন্ডি বদ্ধ অবস্থায় অবস্থান করছে এদেশের হাজার হাজার মুসল্লী। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান থেকে এরা সম্পূর্নই বিচ্ছিন্য।
হিসাব করলেই সহজে মেলে, এসমস্ত মাদ্রাসা বেশীর ভাগ গ্রামেই এবং গ্রামের সহজ সরল সাধারণ মানুষ তাদের ছেলে মেয়েদেরকে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে। ধর্মান্ধতা কূসংস্কারাচ্ছান্নতা কূপমন্ডুকতায় ডুবে থাকা সেই গ্রামের মানুষগুলো ভবিষ্যৎ না ভেবেই সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনে।
মাদ্রাসা থেকে পাস করে দরকার হয় চাকুরীর, সেজন্য গড়ে উঠেছে অসংখ্য মসজিদ। যারা কোন মসজিদেই চাকুরী পায় না মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে। শেষতক নিজেরাই কোনক্রমে বেড়া চেড়া দিয়ে মসজিদ খাড়া বসে যেন তেন প্রকারে। লক্ষ লক্ষ মানুষ ধর্মীয় ভাবাবেগে পড়ে, মাদ্রাসায় শিক্ষাই জীবনের সবকিছু বুঝে নিচ্ছে। আর এই সুযোগে স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকার ইসলামের কথা বলে মাদ্রাসার নিরিহ ছেলেমেয়েদের ইসলাম শিবিরে ভিরাতে সচেষ্ট হয়।
ভূল ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের প্রগতিশীল রাজনীতি সংস্কৃতির অঙ্গনকে ঘোলা করার চেষ্টার সুযোগ নিচ্ছে। যারা এই সকল কার্য্যকলাপ এর নেতৃত্ব দেন তারা প্রায় সকলের নিজেদের মওলানা আখ্যা দেন। অথচ প্রায় প্রত্যেক মওলানার সন্তানরা ইংরেজীতে অথবা উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশে লেখাপড়া করছে। বাংলাদেশের সঠিক উন্নয়নে মাদ্রাসা শিক্ষা কোন ফলপ্রাপ্ত কাজেই আসে না। বরং এখন দেখা যাচ্ছে মাদ্রাসা শিক্ষার নামে সেখানে জামাত শিবির সংগঠন করার উত্তম জায়গা পেয়ে বসেছে। গ্রামীন ব্যাংক সহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কাজে বাধা প্রাপ্ত করানো হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে অবুঝ ছেলে মেয়েদের দিয়ে উন্নয়নে বাধাপ্রাপ্ত করানো হয়। শুধুমাত্র ধর্মীয় গোঁড়ামীর কারনেই এই মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সরকার এর লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যায় হচ্ছে। কেউ কি একটি যুক্তি দেখাতে পারেন, যে আল্লাহর দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা। কিন্তু গুরুত্ব তো ভিন্ন বাস্তবতা চলে অর্থনীতির ভাষায়।
আবেগের কথা বলে তো অর্থনীতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। দেখা যায় মাদ্রাসা থেকে পাস করে ছেলে বা মেয়ে যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তখন তাদের সন্তানের সংখ্যা ক্রমান্ব্যয়ে বাড়তেই থাকে। অপরদিকে বাংলা ও ইংরেজি মিডিয়ামে শিক্ষিত হয়ে কম ব্যাক্তিরাই বিবাহের পর দুটির অধিক সন্তান নিচ্ছেন।এসব সমস্ত দিক বিবেচনায় রেখে, মাদ্রাসা শিক্ষাকে তুলে দেওয়াই সর্বোত্তম বুদ্ধিমানে কাজ। অথবা, মাদ্রাসা শিক্ষাকে সম্পূর্ন বাংলা মিডিয়ামের মত সাধারন শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ে এসে সেখানে ইসলাম ধর্ম শিক্ষা র উপর জোর দেয়া যেতে পারে। এটা বিশ্বকালীন স্বীকৃত যে, কোন একক ধর্মের উপর ভিত্তি বা মতবাদের উপর ভিত্তি করে দেশ বা জাতী আর চলতে পারেনা, উন্নতির দিকে ধাবীত হতে পারে না।
আমরা সোভিয়েতের কম্যূনিজম, ইরানের ইসলাম, আমেরিকার পূঁজিবাদ থেকে শিক্ষা নিতে পারি। কেউ তার একক মতবাদের উপর টিকতে পারেনি। আর এখানে আমাদের দেশে এখন ও ৮০% এর বেশী লোক অশিক্ষিত সেখানে দু তিনটি ভাষা শিক্ষা দিয়ে লাভ কি? দীর্ঘ মেয়াদী পরীক্ষা এদেশে কখনো নেয়া হয় নি। প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষাকে সবার বাধ্যতা মূলক করে জাতীর বেইজ বা মৌলিক চরিত্র গঠন শিক্ষা দেয়া উচিত সকলের আগে প্রাসঙ্গীকতায় এসে যায় একটি কথা সেটি হলো। আমাদের দেশে সকল ধর্মীয় কার্যক্রম বাংলা ভাষায় হওয়া উচিৎ, তাহলে মানুষকে ধোঁকা দেয়ার সুযোগটা কম থাকবে।
যেমন ইসলাম ধর্মের নামাজ, আজান, সুরা পাঠ, জানাযা, মিলাদপড়া, দোয়া প্রভৃতি সকল কিছু বাংলায় পড়ানো যেতে পারে। ঠিক তেমনি ভাবে, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বী গনের উচিত যেহেতু, সকলেই বাংলাদেশের নাগরীক এবং বাংলা ভাষায় কথা বলেন, সেহেতু তাদের সমস্ত ধর্মীয় কার্য্যক্রম বাংলা ভাষায় পরিচালিত করা। এতে করে সকল ধর্ম সম্পর্কে মানুষ যেমন স্বচ্ছ ধারা নিতে পারবে। ঠিক তেমনি ভাবে, ধর্মীয় গোঁড়ামি কমে আসবে। কুসংস্কার, অন্ধত্ব চলে যাবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হওয়ার কারণে দেশে একক ধর্মের বিধান চাপানোর একটা চেষ্টা চলছে, কিন্তু এটা ভালো করেই জানা উচিৎ, এটা হতো না যদি নিজ ভাষায় ধর্ম প্রচারের ব্যাবস্থা করা হতো, তাহলে জনসাধারনের বুঝতে অসুবিধা হতো না।
লেখক : কলামিস্ট, সাবেক ছাত্র নেতা