প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে জনশক্তি রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দানা বাঁধছে শত্রুতা, চলছে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর সরকারের তৎপরতায় খুলেছে মালয়েশিয়ার শ্রম বাজার। দুই দেশের সরকার পর্যায়ে জি টু জি প্লাস চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাচ্ছে মালয়েশিয়াতে। দেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটি সরকারের মাধ্যমেই নির্ধারিত। অথচ এই ১০টি প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের নেতিবাচক প্রচারণা চালাচ্ছে মালয়েশিয়ার বাজার নিয়ে। শুধু তাই নয়, অহেতুক অভিযোগ তুলে এই ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সিকে হয়রানি করার চেষ্টা করছে। থমকে দিচ্ছে মালয়েশিয়ার বাজার। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না পেরে প্রতিষ্ঠিত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে ভিত্তিহীন অভিযোগনামা দাখিল করে এক ধরনের ধোঁয়াশা পরিস্থিতি তৈরি করছে ওই চক্রটি। এমনই প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়েছে দেশের জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে অন্যতম দক্ষ প্রতিষ্ঠান ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসালট্যান্টস লিমিটেড (আর এল নং ৪০৩)। ২০১৪ সালে ক্যারিয়ার ওভারসিস ইরাকে ১৮০ জন কর্মী পাঠিয়েছিল। ইরাকে কর্মী পাঠানো নিয়ে ওই সময় একটি অভিযোগ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং ইরাকে বাংলাদেশি দূতাবাস কর্তৃক উপর্যুপরি তদন্ত হয়। ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে পৃথক তদন্তে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত না হওয়ায় বিষয়টি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চিঠির মাধ্যমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি ক্যারিয়ারসহ আরও কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে অতীতে একাধিকার মন্ত্রণালয় কর্তৃক তদন্তের পর নিস্পত্তিকৃত অভিযোগ সামনে টেনে বেনামে নতুন করে অভিযোগ দেওয়া হচ্ছে। আলাপকালে একজন জনশক্তি রপ্তানি বিশেষজ্ঞ বলেন, যেহেতু অভিযোগ পেলে সেটি খতিয়ে দেখাটাই স্বভাবিক। তাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও বেনামি অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে। এতে জনশক্তি রপ্তানিতে সরকারের নিয়োগ অনুমতি থমকে যাচ্ছে। এই প্রভাব পড়ছে গোটা জনশক্তি রপ্তানি খাতে। এ ব্যাপারে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি বলেন, নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া অভিযোগও কেউ চাইলে আবারও পুনরায় তদন্ত হতে পারে। অভিযোগ প্রমাণিত না হলে আবারও আমরা নিয়োগানুমতিসহ সব ধরনের সহযোগিতা করবো। বিষয়টি সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এখানে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার সভাপতি বেনজির আহমেদ বলছেন, নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া বিষয়ে আবারও তদন্ত হতে হলে তো অভিযোগও সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। এমনকি অভিযোগকারীও সুনির্দিষ্ট হতে হবে। অনির্দিষ্ট কেউ কিন্তু অভিযোগকারী হতে পারেন না। তিনি বলেন, এভাবে এ বাজার টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। যদি কারো ভিসা হয়ে যায়, ভিসা নষ্ট হয়ে যায়, যদি সরকার অনুমতি না দেয় তাহলে তো কিছু করার থাকবে না। এরইমধ্যে হাজার হাজার ভিসা আটকে গেছে। ২০১৪ সালে ‘যশোর রাইটস’ নামে মানবাধিকার সংগঠন ইরাকে কর্মী পাঠানো নিয়ে ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসালট্যান্টস লিমিটেডের বিরুদ্ধে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছিল। ওই সময় এনজিও চক্রের বহুমুখী নেতিবাচক প্রচারণায় কয়েকটি পত্রিকায় ক্যারিয়ারকে নিয়ে কিছু লেখালেখিও হয়েছিল। কিন্তু পরে মন্ত্রণালয়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তে দেখা যায়, ওই অভিযোগে বিষয়ে ক্যারিয়ারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বরং ক্যারিয়ার ওভারসিজ যে কর্মীদের কল্যাণের বিষয়টি ইরাকের দূতাবাসের সহযোগিতায় নিশ্চিত করেছিল তাও নিশ্চিত করা হয়েছিল। বছর না ঘুরতেই নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগটি আবারও নতুন করে বেনামি আবেদনের মাধ্যমে সামনে আনা হয়। এবারও মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করে। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব শোভা শাহনাজ স্বাক্ষরিত চিঠিতে (স্মরক নং-৪৯.০০.০০০০.১০১.১১.০২৮.১৫-৭০) জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়, ইরাকে কর্মী পাঠানোর বিষয়ে রিক্রুটিং এজেন্সি ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসালট্যান্ট লিমিটেডের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়ম বা অপরাধ করার বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি। এর পরও সঙ্গবদ্ধ চক্রটি থেমে যায়নি। এ বছর আবারও একাধিকবার নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগটি বেনামি আবেদনের মাধ্যমে সামনে আনা হয়েছে। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা সূত্রে জানা গেছে, মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যকার জি টু জি প্লাস চুক্তির মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে জনশক্তি রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। দেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে মালয়েশিয়াতে বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানো হচ্ছে। ক্যারিয়ার ওভারসিজ কনসালট্যান্টস লিমিটেড তাদের একটি। এই প্রতিষ্ঠানটি দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে আসছে। সৌদি আরবের নেসমা কন্ট্রাকটিং কোম্পানি, আল সেইফ কন্সট্রাকশন অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, আল হারফি ফুড, জামিল গ্রুপসহ বিভিন্ন নামকরা প্রতিষ্ঠানে লোক পাঠাচ্ছে। এ ছাড়া কাতারে মিডম্যাক, গালফ হাউজিং অ্যান্ড কন্ট্রাকটিং এবং কাতার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্ট্রাকটিং কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করেছে ক্যারিয়ার ওভারসিজ। একইভাবে জি টু জি প্লাস চুক্তির আওতায় মালয়েশিয়াতেও দক্ষতার সঙ্গে কর্মী পাঠাচ্ছে তারা। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, একসময় কুয়েত ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাজার। অথচ এখন পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে বাজারটি। এ ছাড়া ছোট হয়ে এসেছে সৌদি আবরের শ্রম বাজার। লিবিয়ার দুয়ারও বন্ধ। ইরাকও প্রায় বন্ধের মতোই। অথচ জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনাময় এই খাত থেকে অতীতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এখন মালয়েশিয়ার বাজারটিই চাঙ্গা রয়েছে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার নামে কিছু কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির অহেতুক শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে এই বাজারটিও যেকোনো সময় সীমিত কিংবা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব সময় চান বিদেশের বাজারে বাংলাদেশ থেকে বেশি বেশি কর্মী পাঠানো হোক। সম্প্রতি কুয়েতের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি ভালোভাবে নেননি। মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানি আরও বৃদ্ধি হোক, এটি তিনি চান। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সজাগ না হলে তৃতীয় কোনো পক্ষ এ থেকে সুবিধা নিতে পারে বলে এ খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। পুরোনো অভিযোগ নতুন করে তোলার কৌশলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গোটা জনশক্তি রপ্তানি খাত। এতে সাময়িকভাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ অনুমোদন বন্ধ থাকছে। বায়রা সূত্র বলছে, এ পর্যন্ত দুই হাজারের বেশি কর্মীর ভিসা হয়ে আছে। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান লোক পাঠানোর জন্য চাপ দিচ্ছে। যিনি বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য যাবেন, সেই কর্মীও আশায় বুক বেঁধে থাকছেন। অথচ একটি ঈর্ষান্বেষী চক্রের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এ খাত সংশ্লিষ্ট একটি বড় অংশ। আন্তর্জাতিক কর্মসংস্থান বাজারেও বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারনা তৈরি হচ্ছে। ক্যারিয়ার ওভারসিজের চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বলেন, ‘আমরা সুনামের সাথে সততা ও নিষ্ঠা বজায় রেখে দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানি করছে। ২০১৪ সালে ইরাকের নাজ্জাফে আবু তোরাব হাউজিং কোম্পানিতে লোক পাঠানোর পর যে সাময়িক সমস্যা হয়েছিল তার জন্য আমরা দায়ী নই। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের অতৎপরতার কারণে সাময়িক সমস্যা হয়েছিল। আমরা তখন সাথে সাথে ইরাকে বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় আমরা কর্মীদের কল্যাণ নিশ্চিতে যা যা করণীয় সব করেছি। একাধিকবার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তদন্তে কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি। এ ব্যাপাওে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, ‘পুরোনো অভিযোগ যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে করতে পারে। এভাবে যদি সাময়িকভাবে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করানো যায়, তাহলে তো গোটা জনশক্তি রপ্তানি খাতই ক্ষতির মুখে পড়ে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে এবং বেনামা অভিযোগকে আদৌ আমলে নেওয়া ঠিক হবে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ার জনশক্তি বাজার খোলা আছে। যারা কর্মী পাঠানোর সুযোগ পেয়েছেন তারা কাজটি করছে। আর যারা পাননি তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে যারা সুুযোগ পেয়েছেন তারা।’