আত্মশুদ্ধি, মানবতা ও সামাজিকতার পথ যখন রুদ্ধ হয়, গীবত বদনাম অবচেতনা ও অসমালোচনার পথ বৃদ্ধি পায়। সমাজে কুপ্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কুপ্রবৃত্তি ও ভ্রান্ত পথ পরিহার পূর্বক সুপথের দিকদর্শন ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা তখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দেয়।
মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর একজন অতি নগন্য শিষ্য, সুহৃদ ও রাজনৈতিক অনুসারী ছিলাম। মাওলানা ভাসানীর পুত্র আবু নাসের খান ভাসানীসহ তাদের পরিবারের সাথে একাধারে ১৫ বছর কাটানোর সুযোগ হয়েছে। এছাড়া ভাসানী ন্যাপের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয় যুবদল কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তাদের পাশে থেকে কমবেশী অনেক কিছু দেখা ও জানার সুযোগ হয়েছে। মাওলানা ভাসানীর আশেপাশে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দেশের বড় মাপের অনেক নেতা, সমাজকর্মী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে শাসন, প্রশাসন, আইন ও বিচার বিভাগের লোকজনসহ সামরিক, বেসামরিক পর্ষদের অনেককে যেতে দেখেছি। এ নিবন্ধে তাদের পরিচিতি কলামের সংক্ষিপ্ততার কারণে উল্লেখ করা হয়নি।
মাওলানা ভাসানীর জীবদ্দশায় প্রতিদিন দেশের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, দেশী বিদেশী সাংবাদিক, সাধারণ মানুষ ও বিশিষ্ট জনদের ভীড়ে তার আশেপাশে যাওয়াটা ছিল প্রায় সময়েই দূরুহ। যদিও তা পুলিশ প্রটেকশনের বাধা ও তাহার নিরাপত্তার কারণে নয়। এটাই ছিল তাহার জীবদ্দশার সাধারণ চিত্র। অনেক সময় ইচ্ছা করলেও অনেকের সেবাযতœ ও শ্রুশ্রুষার কারণে আমার মতো অনেকেরই তাহার পায়ের জুতায় কালি দিতে গিয়েও হিমশিম খেতে হয়েছে। কে উনার শরীরে ও মাথায় তেল দিবে, কে কাপড়-চোপড় ধৌত করবে এ নিয়েও রীতিমতো প্রতিযোগিতা ঈড়সঢ়বঃরঃরড়হ চলত। তাহার জন্ম ও মৃত্যু দিবসে দেশের অনেক জ্ঞানী, গুনী, বিদগ্ধজন, রাজনৈতিক অনুসারী ও দেশের প্রথিতযশা সাংবাদিক, লেখক, কলামিস্টসহ অনেকেই তা বিশদভাবে আলোকপাত করে থাকেন।
১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি গঙ্গার পানির ন্যায্য দাবীতে এবং ভারতীয় পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেছিলেন। তখন আমার মতো হাজার হাজার লোক এই লংমার্চে সামিল হয়। ঐ দিন তিনি পদ্মার পাড়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানষাট হাইস্কুল ময়দানে সমবেত হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে দিক নির্দেশনামূলক বক্তৃতা,
জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাংকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। এ সভার পর তিনি কানষাট থেকে সরাসরি টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার বাসস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন।
পরের দিন ১৮ নভেম্বর দেশের অগনিত নেতাকর্মী, সুহৃদ, ভক্ত ও শিষ্যরা সন্তোষের টাঙ্গাইলে মাওলানা ভাসানী হুজুরের সাথে সাক্ষাৎ করতে যায়। দেশী বিদেশী সাংবাদিকরাও সন্তোষে ভীড় জমায়। যে কারণে মহান নেতাকে এক নজর দেখা ছাড়া আমার মতো আরও অনেকেরই সাক্ষাৎ করা সম্ভব হয়নি। তার পরের দিন ১৯ ও ২০ নভেম্বরও দেখা করা সম্ভব হয়নি। ২১ নভেম্বর মাওলানা ভাসানীর বড় মেয়ের জামাতা পাবনার এডভোকেট সবুর সাহেব, ন্যাপনেতা নূর মোহাম্মদ খান, নান্নু ভাই, পুত্র আবু নাসের খান ভাসানী, মশিউর রহমান যাদু ভাই ও কাজী জাফর আহমদের সানন্দ ভালোবাসার নিরিখে ও সহযোগিতায় কিছু সময়ের জন্য মহান নেতা ভাসানী হুজুরের সাথে সন্তোষের দরবার হলে কয়েকজনের সাক্ষাতের সুযোগ ঘটে। তখন হুজুর ভাসানী কিছু পরামর্শ উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। তা ছিল, আত্মশুদ্ধি, গীবত পরিহার, সচেতনতা ও অসমালোচনা বর্জন প্রসঙ্গে। যা আজও মনে পড়ে।
তিনি বলেছিলেন, নিজে সংশোধন না হয়ে অন্যকে নিয়ে চর্বিত চর্বন, অসমালোচনা, পরনিন্দা ও গীবত না বলা। যদি কারও কিছু ভালো কাজ ও গুণ থাকে তা প্রকাশ করা। প্রয়োজন বোধে সচেতনতার পরামর্শ ও সংশোধনের চেষ্টা করা। কোনো অবস্থাতেই গীবত বদনাম না করে তা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করা। আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা, বিশ্বাস ও ঈমান রেখে ধৈর্য ধারণ ও সংযত হওয়ার চেষ্টা করা। আরও বলেন, ইহাই হুক্কুল এবাদ ও আমার প্রতিষ্ঠিত খোদায়ে খিদমতগার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ও দর্শন। যদি আমি বেঁচে না থাকি, তোমরা আমার রাজনৈতিক দর্শন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, কামার, কুমার, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি জনতা ও সর্বহারা মানুষের ন্যায় সংগত অধিকারের পাশে থাকবে। এর কয়েক মাস ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন।
আজ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, কিছু লোকের গীবত ও অসমালোচনা মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের আত্মশুদ্ধির তো খবরই নেই। পরনিন্দা, পরের অপবাদ, অন্যের ক্ষতিসাধন ও পরের পাচায় অহরহ আলকাতরা লেপনই যেন চিরচারিত দর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে শাসন, প্রশাসন বিভাগসহ সর্বত্র যেন এ ঘোড়া রোগে আক্রান্ত। যা দেখে আত্মশুদ্ধি, গীবত, অসমালোচনা পরিহার ও সচেতনতা প্রসঙ্গে কিছু না বললেই নয়। একজন পন্ডিত ব্যক্তির উক্তি থেকে জানা যায়, সমাজে যতগুলো হিং¯্র ঘটনা, অবিচার প্রতিফলিত ও সংঘটিত হয়ে থাকে এসবের অধিকাংশই কান কথা, আত্মশুদ্ধির অভাব, গীবত, অসমালোচনা ও অসচেতনতারই প্রতিফলন।
একজন সরকারি কর্মকর্তার আচার, আচরণ, সানন্দ ও সুন্দর ব্যবহার, ন্যায়নিষ্ঠা ও আদর্শ দেখে এক সময় তাহার সাথে সুম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই সময় ল্যান্ড টেলিফোনই ছিল একমাত্র যোগাযোগ রাখার মাধ্যম। মোবাইল যোগাযোগ তখন ছিল না। প্রায় সময়ই ঢাকায় তার অফিসে যেতাম। যেদিন যেতে পারি নাই সেদিন ফোনে তার খোঁজ খবর নিতাম। তদোপরি তিনিও আমার খবর নিতেন। তার কাছে যেতে দুই তিনদিন দেরী হলে তিনি ফোনের পর ফোন করতেন। অনেক সময় রাজনৈতিক, পারিবারিক ও সামাজিক ব্যস্ততার মাঝেও তাহাকে সময় দিতাম। যতবারই তার কাছে গিয়েছি ততবারই তিনি নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকলেও কোন দিন তার মুখ থেকে অন্যের প্রশংসা কর্ণকুহরে পৌঁছেনি। এছাড়া তিনি অন্যের অসমালোচনা ও গীবত বলতে এমন পারদর্শী ছিলেন, যা শুনতে, শুনতে কান জ্বালাপোড়া হয়ে যেত। তার চাকরির পদ পদবী ও বয়সের কথা ভেবে আত্মশুদ্ধি, গীবত পরিহার ও সচেতনতার ব্যাপারে পরামর্শ বা কিছু বলার সুযোগ ছিল না। যদিও তিনি ছিলেন খুবই ন্যায় নিষ্ঠাবান ও আদর্শিক সরকারি কর্মকর্তা।
এই সব কিছু শুনতে শুনতে কান জ্বালাপোড়া ও অসহ্য হয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর দূর থেকে নিজেকে আড়াল রেখে একদিন বলেছিলাম, আমার পক্ষে আপনাকে পরামর্শ বা উপদেশ প্রদান করা আদৌ সম্ভব নহে। যদি অনুগ্রহ পূর্বক অনুমতি প্রদান করেন তবে পরামর্শ নয়, তবে কিছু কথা বলব। তাতে তিনি বললেন, অনুমতি দেয়া হলো। বললাম, সমাজে ও কর্ম পরিষদের ভালো জায়গায় থেকে কিছু লোক তোয়াজ, তোষনকে ভূষন মনে করে অবচেনতার কারণে অহরহ অসচেতনতার ডোবা নালা ও খালে বিলে হাবুডুবু ও ব্যাঙ খায়। সেটা হলো, একবার এক কৃষক তার স্ত্রীকে একটি কবুতরের বাচ্চা রান্না করার জন্য দেয়।
বলে যায়, আমি হালচাষ করে ফিরে এসে কবুতরের বাচ্চার তরকারি দিয়ে ভাত খাব। ইতোমধ্যে কবুতরের বাচ্চাটি রান্নাঘর থেকে বিড়ালে নিয়ে যায়। বেচারী গৃহিনী স্বামীর ভয়ে পাশের ডুবা থেকে একটি ব্যাঙ এনে কবুতরের বাচ্চার মতো রান্না করে রাখে। এ ঘটনা গৃহিনীর ছোট বাচ্চা দেখে ফেলে। যখন গৃহকর্তা খেতে বসল, তখন তার বাচ্চাটি বলল, বাবা আমি যদি সত্য বলি তবে তুমি ব্যাঙ খাও। আর যদি মিথ্যা বলি তবে তুমি হালুম হালুম করে কবুতরের বাচ্চা খাও। আজ তোয়াজ, তোষন ও কান কথার কারণে এবং বড় সাহেবদের ভুল বুঝাবুঝিতে কত অসহায় অধীনস্তরা বদলী ও সাসপ্যান্ড যাতনায় যে অহরহ নিপতিত হয়ে কবুতরের বাচ্চা মনে করে ব্যাঙ খাচ্ছে তার যেন শেষ নেই।
একবার হতদরিদ্র এক মহিলা রাসুল সাঃ এর দরবারে গিয়ে হাজির। মহিলা বলল, হে রাহমাতুল্লিল আল আমীন, হে দুজাহানের মাল্লিক আল্লাহ রাব্বুল আল আমীনের হাবিব, আমি আপনার কাছে একটি আরজ নিয়ে এসেছি। আমি খুবই গরীব ও অসহায়। আমার ছেলেকে প্রতিদিন অতি কষ্টে করেও মিষ্টি খাওয়াতে হয়। যা আমার জন্য জুলুম। দয়া করে এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পরামর্শ দান করুন। রাসূল সাঃ মহিলাকে একটি সময় দিয়ে আসার কথা বললেন। তিনি নিজেও মিষ্টি পছন্দ করতেন। ইত্য সময়ে রাসূল সাঃ আত্মশুদ্ধির পথ বেচে নিয়ে মিষ্টি খাওয়া ছেড়ে দেন। নির্ধারিত সময়ে উক্ত মহিলা আসলে তার ছেলেকে মিষ্টি খাওয়া ত্যাগ করার অছিয়ত পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
রাসূল সাঃ মেরাজ শরীফ গমনকালে লক্ষ্য করলেন, কিছু লোক হাতের আঙুলে তামার ধারালো আংটা দ্বারা মুখ মন্ডল থেকে শূরু করে শরীরকে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করছে। তা দেখে তিনি জানতে পারলেন, এই লোকগুলো জীবদ্দশায় গীবত করতো। এমনিভাবে সহি হাদীসে উল্লেখ আছে গীবতখোর আপন মৃত ভাইয়ের পঁচা মাংস চিবিয়ে খায়।
আজ সমাজের সর্বত্র যেভাবে আত্মশুদ্ধি ও সচেতনতার পথ রুদ্ধ হয়ে যেভাবে তোয়াজ, তোষন, ভুষণ ও গীবত দর্শন চলছে, এসব থেকে পরিত্রানের লক্ষ্যে গীবত, অসমালোচনা পরিহার, সংশোধন, আত্মশুদ্ধি ও সচেতনতাই একমাত্র মুক্তি ও পরিত্রানের পথ। রাসূল সাঃ বলেছেন, কারও সম্পর্কে মন্দ ধারণা হতে বেঁচে থাক। যে কোনো ধারণা বড় ধরণের মিথ্যা। কারও গোপন দোষ তালাস করনা, চুলককারি ও গোয়েন্দা গিরি করো না। ক্রয় বিক্রয়ে ধোঁকাবাজী, পরস্পর হিংসা, শত্রুতা পোষন এবং অন্যের পেছনে লেগনা। বরং আল্লাহর বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও বুখারী শরীফ হাদীস ৬০৬৫ । আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন আমাদিগকে আত্মশুদ্ধি, গীবত থেকে দূরে থাকা, অবচেতনার পথ পরিহার পূর্বক সচেতনতার পথে চলার রহমত ও তসরিফ দান করুন। আমরা যা বলি তা করি না, যা করি তা বলি না। কথা, বাক্য ও বলার সমন্বয়তার মাঝেই সবকিছুর সফলতা অর্ন্তনিহীত। শাসকদের সামান্য ভুলের কারণে কত বিশাল ক্ষতি পোহাতে হয় এমন একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে ১৭৯৯ সালে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধরত ছিলেন নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। একদিন তিনি সহকারীদের বললেন, ১ হাজার ২০০ শত তুর্কি বন্দীকে মুক্তি দিতে। কিন্তু আদেশ প্রদানের ওই মুহুর্তেই বেদম কাশি শুরু হয় তার। বিরক্ত হয়ে নেপোলিয়ন বলেন, মাসাকরি তাকস অর্থাৎ কী বিদঘুটে কাশি। সহকারীরা ভুলে শুনলেন, ‘মাসাকরি তাওস’ অর্থাৎ হত্যা করো সবাইকে। সেদিন সামান্য শব্দের হেরফেরে প্রাণ গিয়েছিল ১ হাজার ২০০ শত সৈন্যের। তাই তোয়াজ, তোষন, ভূষন, গীবত, অসমালোচনা ও অসচেতনতার কারণে কত অসহায় মানুষের যে সর্বনাশ হচ্ছে এর খবর রাখেই বা কজনা। এসবের পরিসমাপ্তিই প্রত্যাশা। পরিশেষে একজন ইসলামি চিন্তাবিদের গবেষণা থেকে বলব, কান কথা, গীবত, অসমালোচনা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতা পরিহার ও শুদ্ধাচারে আত্মশুদ্ধিই এসব থেকে পরিত্রান ও দূরে থাকার উত্তম দিক দর্শন ও আলোর পথের দিশারী।