দেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সে হারে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। আর কর্মসংস্থান না বাড়ায় বেকারত্বের হারও আশানরূপভাবে কমছে না। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হয়ে যে সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামছে সে তুলনায় নিয়োগের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সূত্রমতে, প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখেরও বেশি মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে চাকরির খোঁজে। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ লাখ উচ্চশিক্ষিত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণেরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাঁদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যেও বেকারত্বের হার বাড়ছে। সম্প্রতি শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ানের সংসদে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ লাখ ৫ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৪ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭১ হাজার। অন্যান্য বেকার ৯ হাজার। প্রতিমন্ত্রী পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) পরিচালিত শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭ সালের রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সী বেকারের সংখ্যা তুলে ধরেন। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭৭ হাজার। এদের মধ্যে শিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত ২৩ লাখ ৭৭ হাজার এবং অশিক্ষিত ৩ লাখ। প্রতিমন্ত্রীর তথ্য অনুযায়ী অশিক্ষিত ৩ লাখ বেকারের মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ২৭ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭৩ হাজার। প্রাথমিক পাস বেকারের সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ২ হাজার এবং নারী ২ লাখ ২৬ হাজার। মাধ্যমিক পাস ৮ লাখ ৯৭ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ৪ লাখ ২২ হাজার এবং নারী ৪ লাখ ৭৪ হাজার। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বেকার ৬ লাখ ৩৮ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ৩ লাখ ৫৩ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭১ হাজার। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ৪ লাখ ৫ হাজার বেকারের মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৩৪ হাজার এবং নারী ১ লাখ ৭১ হাজার। অন্যান্য বেকার ৯ হাজার। এদিকে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) আঞ্চলিক কর্মসংস্থান নিয়ে তৈরি প্রতিবেদন ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ অনুযায়ী বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব ২০১০ সালের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে ২০১৭ সালে ১২ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়ায়। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্ব ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় ২৮টি দেশের মধ্যে ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের তরুণদের বড় অংশ আবার নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কোনো ধরনের শিক্ষায় যুক্ত নন, প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন না, আবার কাজও খুঁজছেন না। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে এমন তরুণের হার ২৭ দশমিক ৪ শতাংশ। মেয়েদের মধ্যে এই হার বেশি, ৪৫ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর পার হয়নিÑএমন মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে কম (১ দশমিক ৮ শতাংশ)। প্রাথমিক পর্যায় শেষ করা মানুষের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। যাঁরা মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষিত, তাঁদের মধ্যে বেকার সাড়ে ৮ শতাংশ। উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ। সূত্রমতে, সরকারি চাকরিতে মোট নিয়োগের প্রায় অর্ধেক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পাস করা। বাকিরা অষ্টম শ্রেণি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা। অন্যদিকে, বেসরকারি খাতে দরকার কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবল। কিন্তু দেশের উচ্চশিক্ষিতদের সে জ্ঞান না থাকায় তাঁরা চাকরি পাচ্ছেন না। সাধারণত, বেসরকারি কারখানায় শ্রমিক ও কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের দরকার হয় ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও হয়। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের ৯০ শতাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, যার সঙ্গে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার কোনো সম্পর্ক থাকে না। বেকারদের মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে অধ্যয়নকারী উচ্চশিক্ষিতরাই বেশি। বাংলাদেশে ভালো চাকরির আশায় প্রতিবছরই উচ্চশিক্ষায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু তাদের কর্মক্ষেত্র বাড়ছে না। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেশি থাকার আরেকটি কারণ হলো, সমাজে যে ধরনের কাজ পাওয়া যায়, উচ্চশিক্ষিতরা সে ধরনের কাজ করতে আগ্রহী নন। কিন্তু তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির ক্ষেত্রও কম। আর তাঁদের প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরির জন্য যে ধরনের কারিগরি জ্ঞান দরকার, তা তাঁদের নেই। পাশাপাশি, দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী যে হারে বাড়ছে, সে হারে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে না -এটিও বেকারত্ব বাড়ার বড় কারণ বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। সূত্রমতে, কর্মসংস্থান না কমলেও চাহিদা অনুযায়ী তা বাড়ছে না। সরকার নতুন নতুন অর্থনৈতি অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করলেও সেগুলো এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি এবং বেশিরভাগই নির্মাণাধীন। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগও অপ্রতুল। সে কারণে বেকার সংখ্যা বাড়াটা স্বাভাবিক। কেননা, প্রতিবছর যে সংখ্যক মানুষ কর্মের বাজারে প্রবেশ করছে সে তুলনায় কর্মসংস্থান হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই হারে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। এজন্য শুধু প্রবৃদ্ধি বাড়ালেই হবে না। কর্মসংস্থানের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। যাতে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের সংযোগ ঘটে।