নানান সমস্যা আর অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর লাভের মুখ দেখা তো দূরের কথা, বরং প্রতিবছরই তাদের লোকসানের আকার বাড়ছে, সাথে বাড়ছে দেনার পরিমাণ। বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন ১৫টি চিনিকলের মধ্যে ১৪টিই লোকসানে। সূত্রমতে, গত অর্থবছরে নিট লোকসান হয়েছে ৮৩৪ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। এছাড়া, বিএসএফআইসি’র অধীনে থাকা চিনিকলগুলোতে গত ১৭ বছরে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি লোকসান হয়েছে। লোকসানের পাশাপাশি করপোরেশনের ব্যাংকঋণ ও দায়দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় পৌনে ৭ হাজার কোটি টাকা। লোকসান কমাতে এখন সংস্থাটি ব্যাংকঋণ সুদসহ এককালীন মওকুফ চাইছে।
বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে থাকা ১৫টি চিনিকল হল- পঞ্চগড় সুগার মিলস, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস, সেতাবগঞ্জ সুগার মিলস, শ্যামপুর সুগার মিলস, রংপুর সুগার মিলস, জয়পুরহাট সুগার মিলস, রাজশাহী সুগার মিলস, নাটোর সুগার মিলস, নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলস, পাবনা সুগার মিলস, কেরু অ্যান্ড কোম্পানি, কুষ্টিয়া সুগার মিলস, মোবারকগঞ্জ সুগার মিলস, ফরিদপুর সুগার মিলস ও জিল বাংলা সুগার মিলস। এর মধ্যে কেরু ছাড়া বাকি ১৪টি চিনিকল দীর্ঘদিন থেকেই লোকসান গুনছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে কেরুর লাভ হিসাবে নিয়ে চিনিকলগুলোর লোকসান ছিল ৩১৪ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সেটি দাঁড়ায় ৬৪১ কোটি টাকায়। আর গত বছর লোকসান ৮৩৪ কোটি টাকা। এই ১৫ চিনিকলের উৎপাদন ক্ষমতা বছরে প্রায় ২ লাখ ১০ টন। কিন্তু উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকও চিনি উৎপাদন করতে পারছে না চিনিকলগুলো। গত ছয় বছরের হিসাবে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার ২৬৮ টন। আর গত বছর ছিল ৬৮ হাজার ৫৬২ টন। চিনি উৎপাদন করা মূল কাজ হলেও প্রতিষ্ঠানটি ২০১৭ সালে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে চিনি আমদানি করে। সে চিনি এখনো পড়ে আছে গুদামে।
বাংলাদেশে প্রথম প্রজন্মের শিল্পগুলোর একটি হল চিনিকল। স্বাধীনতার আগে ও পরে সরকারি চিনিকলগুলোই দেশের চাহিদা পূরণ করত। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে এসব চিনিকলের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো হয়নি। আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়নি। আখ চাষ বাড়ানোরও উদ্যোগ ছিল না। বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিপুল উৎপাদন ক্ষমতার মিল চালু হয়েছে। ফলে বাজারে সরকারি চিনিকলের ভূমিকা এখন গৌণ হয়ে গেছে। দুটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর এখন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বিএসএফআইসির আওতায় চিনিকল আছে ১৫টি। এসব চিনিকলের তিনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্রিটিশ আমলে, নয়টি পাকিস্তান আমলে ও তিনটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। এদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা মাত্র ২ লাখ ১০ হাজার টন।
সরকারি হিসাবে দেশে এখন বছরে ১৪ লাখ টন পরিশোধিত চিনির প্রয়োজন হয়। দেশে চিনির চাহিদা বাড়লেও হ্রাস পেয়েছে সরকারি চিনির উৎপাদন। বলা হচ্ছে, ৫ গুণেরও বেশি খরচে উৎপাদন করছে অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকল। এসব কারখানায় প্রতিকেজি চিনি উৎপাদনে খরচ ১৩৩ থেকে ৩২৫ টাকা হলেও বিক্রি করা হয় মাত্র ৬০ টাকা কেজি দরে। ফলে বর্তমানে চিনি খাতে ৪ হাজার কোটি টাকা লোকসান রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলোর। আর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬ হাজার ৭১০ কোটি টাকা ঋণ ও দায়বদ্ধতা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ চিনিশিল্প করপোরেশনের কাছে আখচাষিদের পাওনা প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেওয়ার পরও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব কারখানা স্থানীয় চিনির চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে, যার প্রধান কারণ দুর্নীতি, আখের স্বল্পতা এবং সরকারকে ব্যক্তি খাত থেকে চিনি কিনতে বাধ্য করা। জানা গেছে, চিনিকলগুলোতে শুধু চিনি উৎপাদন করে লাভের আশা না থাকায় সরকার এখন সেগুলোতে চিনির উপজাত থেকে বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। এজন্য বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছে শিল্প মন্ত্রণালয়।