সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে হাজার হাজার কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) কার্যালয়। সরকারের ৩৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নিরীক্ষা করে ৪৩৪টি অডিট আপত্তির বিপরীতে সিএজি কার্যালয় ওসব অনিয়ম চিহ্নিত করে। মূলত ঋণ জালিয়াতে করে অর্থ আত্মসাৎ, নিয়ম লঙ্ঘন করে প্লট বরাদ্দ, নির্ধারিত অপেক্ষা কম মূল্য দেখিয়ে জমি নিবন্ধনসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সরকারি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিগত ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওসব অনিয়ম হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের কাছে পেশ করেন সিএজি মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। সিএজি কার্যালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সিএজি কার্যালয় থেকে মোট ৩৪টি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। তার মধ্যে ৯টি বিশেষ রিপোর্ট আর বাকিগুলো বার্ষিক রিপোর্ট। তবে রিপোর্টে যেসব অনিয়ম তুলে ধরা হয় সেগুলো সাত-আট বছর আগের ঘটনা। আর অনিয়মের জন্য যাদের দায়ি করা হয়, পরবর্তী সময়ে তাদের অনেকেই চাকরিতে থাকেন না। ফলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। অথচ সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে অডিট রিপোর্টকে বেশি গুরুত্ব দেয়া জরুরি। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদে অডিট রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা ও পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিকে আরো সক্রিয় হওয়া আবশ্যক। মূলত জনবল সমস্যার কারণে বিলম্বে অডিট রিপোর্ট তৈরিতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। পাশাপাশি যেসব মন্ত্রণালয়ের অডিট করা হয় অনেক ক্ষেত্রে সেখান থেকেও অসহযোগিতা করা হয়। ফলে নির্ধারিত সময়ে অডিট করা সম্ভব হয় না।
সূত্র জানায়, যে ৯টি মন্ত্রণালয়ের বিশেষ অডিট রিপোর্ট করা হয় তাতে জড়িত অনিয়মের অঙ্ক ৬ হাজার ১৭১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। ১৪৮টি আপত্তির বিপরীতে ওই পরিমাণ অর্থ চিহ্নিত করেছে অডিট দল। বিশেষ অডিট রিপোর্ট করা মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে গৃহায়ন ও গণপূর্ত, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ উল্লেখযোগ্য। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতাধীন বেসিক ব্যাংকে। অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানকে ঋণ বিতরণ, জামানত বন্ধক না দিয়ে ঋণ মঞ্জুরসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বেসিক ব্যাংকের প্রায় ৩ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকার অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে নিরীক্ষক দল। তাছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিসিআইসির প্রতিষ্ঠান কর্ণফুলী পেপার মিলসের ওপর বিশেষ নিরীক্ষা করেছে সিএজি অফিস। তাতে প্রায় ১ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম খোঁজ মিলেছে। ওসব অনিয়মের মধ্যে রয়েছে- সাশ্রয়ী দামের গ্যাস ব্যবহার না করে অধিক দামের ফার্নেস অয়েল ব্যবহার, ক্রয়কৃত খুচরা যন্ত্রাংশ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা ইত্যাদি। আর্থিক অনিয়মের পাশাপাশি নিরীক্ষক দল বিসিআইসির প্রশাসনিক ও কারিগরি দুর্বলতার বিষয়টি চিহ্নিত করেছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন পল্লী উন্নয়ন বিভাগে নিরীক্ষাকালে অস্তিত্বহীন সমিতির সদস্য দেখিয়ে ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ, সিডর পুনর্বাসন কাজে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করা, কর আদায় করার পর তা সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়াসহ নানা অনিয়ম খুঁজে পাওয়া গেছে। তাতে প্রায় ৩০ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম উঠে এসেছে। তাছাড়া যে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক অডিট রিপোর্ট দেয়া হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জড়িত অনিয়ম সাড়ে ৪ কোটি টাকা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে ২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকা, স্থানীয় সরকার বিভাগে ৩৯ কোটি টাকা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অধীন পাঁচ সরকারি ব্যাংক- সোনালী, জনতা, রূপালী, কৃষি ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে এক হাজার ৭২৭ কোটি ৩৭ লাখ টাকা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগে ১৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে ৭৯১ কোটি ২৭ লাখ টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১০৬ কোটি টাকা, সড়ক পরিবহনে ৩৩ কোটি ১৮ লাখ টাকা, রেলপথ মন্ত্রণালয়ে ২৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। সব মিলে সিএজির প্রতিবেদনে ১১ হাজার ৭১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
সূত্র আরো জানায়, সিএজি প্রতিবেদনে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ৫৪৯ কোটি টাকার অনিয়ম উঠে এসেছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওভারফ্লাইং চার্জ আদায় না হওয়া, বকেয়া ল্যান্ডিং চার্জ আদায় না করা, ইউটিলিটিজ বাবদ বকেয়া, লাঞ্চ ভাতা বাবদ অনিয়মিত ব্যয় ইত্যাদি। আর সিএজির প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ৬৪ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়। ওসব অনিয়মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে টেন্ডার সিডিউল বিক্রি বাবদ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা না দেয়া, জরিমানার অর্থ আদায় না করা, উন্মুক্ত দরপত্রের পরিবর্তে সীমিত দরপত্র অনুসরণ করা ইত্যাদি। রাজউকের ওপর বিশেষ অডিটের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অনিয়ম হচ্ছে- নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্লট বরাদ্দ, আবাসিক প্লটের আয়তন বৃদ্ধির কোনো সংস্থান না করে অধিক আয়তনের প্লট অনিয়মিতভাবে পরিবর্তনের মাধ্যমে বরাদ্দ দেওয়া ইত্যাদি। এসব অনিয়মের সঙ্গে ২৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকার অনিয়ম হয়েছে। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন পরিদপ্তরের আওতাধীন ১৯টি সাব-রেজিস্টার অফিসের এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীন ক্রীড়া পরিষদের বিভিন্ন খাতে ২২ কোটি টাকার অনিয়ম চিহ্নিত করা হয়।
এদিকে সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অডিট রিপোর্ট হালনাগাদ ও মানসম্পন্ন রিপোর্ট করতে হলে সিএজি অফিসকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। তাদের মতে, অডিট রিপোর্টগুলো পুরনো। তাছাড়া নিয়ম অনুযায়ী সিএজি রাষ্ট্রপতির কাছে রিপোর্ট জমা দেয়ার পর ওসব রিপোর্ট জাতীয় সংসদে আলোচনার জন্য জমা দেয়া হয়। এরপর নিষ্পত্তির জন্য পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে (পিএসি) পাঠানো হয়। নিয়ম রক্ষার জন্য অডিট রিপোর্ট সংসদে জমা দেয়া হলেও তা নিয়ে সংসদে আলোচনা কমই হয়। তাছাড়া পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে আলোচনা হলেও কমিটির সিদ্ধান্ত তেমন কার্যকর হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে সিএজির অডিট রিপোর্ট সম্পর্কে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সভাপতি মো. রুস্তম আলী ফরাজী জানান, দেশের অডিটের মূল সমস্যা হচ্ছে প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু অনেক বছরের পুরনো। ফলে ওসব রিপোর্টের কার্যকারিতা তেমন থাকে না। অডিট রিপোর্টকে অধিক কার্যকর করতে হলে হালনাগাদ রিপোর্ট তৈরির ওপর গুরুত্বপূণ। পাশাপাশি অডিটের পরিধি এবং অডিট টিমের সদস্য আরো বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত এবং দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে সিএজি অফিসকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে।