নিয়মকানুনের মানছে না দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। জানা গেছে, ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠার কারণে সরকার ঢাকা মহানগরে নতুন করে আর কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরও রাজনৈতিক প্রভাবে ঢাকাসহ এর পাশবর্তী এলায় নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠছে। একমাস আগে নারায়ণগঞ্জে ২৩ শর্তে নতুন করে আরও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম হচ্ছে- ‘ইউনিভার্সিটি অব স্কিল এনরিচমেন্ট অ্যান্ড টেকনোলজি ট্রাস্ট’।
যে ২৩টি শর্তে এটির অনুমোদন দেয়া হয় তার মধ্যে রয়েছে- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আইন মেনে চলা, ২৫ হাজার বর্গফুট ভাড়া অথবা নিজস্ব ভবন, বিদ্যালয়ে নূন্যতম তিনটি অনুষদ এবং তার অধীনে ছয়টি বিভাগ চালু থাকা, উল্লিখিত ঠিকানা ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো কার্যক্রম পরিচালনা না করা, অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা প্রতিষ্ঠানের কর্মরত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে তার মূল নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র গ্রহণ করা, বিদেশি শিক্ষক অথবা বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি বিধান অনুসরণ করাসহ বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে।
অনিয়মের কারণে একটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এই বিশ^বিদ্যালয় অনুমোদনের পর দেশে এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আছে ১০৫টি। এই মুহূর্তে মোট ৯৫টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। ইউজিসির সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী এগুলোতে মোট শিক্ষার্থী সাড়ে ৩ লাখ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ অনেক। কিন্তু ইউজিসি ও শিক্ষাবিদদের মূল্যায়নে বড়জোর ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভালোভাবে বা মোটামুটিভাবে চলছে। বাকিগুলো কোনো না কোনোভাবে আইনের শর্ত ভঙ্গ করছে। সবকটি শর্ত পূরণ করার প্রক্রিয়া শেষ করেছে মাত্র ৩টি।
জানা গেছে, ২০১০ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের পর থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য ৫১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে কয়েকবার সময় দেয় সরকার। কিন্তু এর মধ্যে সাত বছরের বেশি বয়সী ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৪টি এখনো নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার শর্ত পুরোপুরি পূরণ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সরকার ছয়বার সময় দিয়েছিল। নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১ একর এবং অন্যান্য এলাকায় ২ একর পরিমাণ জমি থাকতে হবে। এই ৩৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৬টি নির্ধারিত পরিমাণ জমিতে নির্মাণাধীন ক্যাম্পাসে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আর দুটি ক্যাম্পাসে গেছে, তবে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম জমিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, সময় পেয়েও যারা নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি, তাদের ছাত্র ভর্তি বন্ধ করাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু তেমনটা হয়নি।
ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, স্থায়ী কাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো- আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, অতীশ দীপঙ্কর বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউসিভার্সিটি, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এ- টেকনোলজি-চট্টগ্রাম, ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, আইইউবিএটি, আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক, গণবিশ্ববিদ্যালয়, বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, সিটি ইউনিভার্সিটি, পুন্ড্রু ইউনিভার্সিটি ও বিইউবিটি।
সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়নের আগে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে আইনে বলা হয়েছে, ‘এই আইনে যাই থাকুক না কেন এই আইন কার্যকর হওয়ার পূর্বে সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে সনদ গ্রহণপূর্বক স্থায়ী না হইয়া থাকিলে এই আইন কার্যকর হওয়ার পর ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ধারা ৯ এর শর্তাবলি পূরণ সাপেক্ষে সনদপত্র গ্রহণ করিতে হইবে। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সনদপত্র গ্রহণ না করিলে ওই সময়সীমার পর সরকার ওই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমতি বাতিল করে উহা বন্ধ করবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার বিষয়ে তাগাদা দেওয়া হয়। আইন পাস হওয়ার পর একই বছর ‘রেড এলার্ট জারি’ করে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ওই সময় অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার উদ্যোগই নেয়নি। পরে দ্বিতীয় দফায় ২০১২ সালে, তৃতীয় দফায় ২০১৩ সালে, চতুর্থ দফায় ২০১৫ সালের জুন এবং পঞ্চম দফায় ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়। এভাবে বারবার সময় বেঁধে দেওয়ার পরও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে ব্যর্থ হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আইনি বাধ্যবাধকতা আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দফায় দফায় আল্টিমেটামে স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে বাধ্য হয়েছে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এরমধ্যে অনেকেই গড়ে তুলেছেন দৃষ্টিনন্দন ক্যাম্পাস। যদিও শতকোটি টাকা ব্যয় করে প্রতিষ্ঠিত এসব ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করছে না অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে স্থায়ী ক্যাম্পাস রয়েছেÑএমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশেরই স্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় অস্থায়ী ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি।
জানা গেছে, অনেকটা চাপে পড়েই স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে বাধ্য হয়েছে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তদারকপ্রতিষ্ঠানের চাপ প্রয়োগের ফলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আয় করা কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে স্থায়ী ক্যাম্পাস করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। যদিও ক্লাস-পরীক্ষা নয়; এসব স্থায়ী ক্যাম্পাস ব্যবহৃত হচ্ছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সমাবর্তনের মতো বিভিন্ন উদযাপনের স্পট হিসাবে।
এ বিষয়ে ইউজিসি বলছে, বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই স্থায়ী ক্যাম্পাস করে চিঠি দিয়ে তা জানিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, স্থায়ী ক্যাম্পাস করেছে ঠিকই, তবে এসব ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা গেছে বিশাল জায়গা নিয়ে মনোরম পরিবেশে ক্যাম্পাস করা হয়েছে। কিন্তু এসব ক্যাম্পাসে না গিয়ে শহরের অলিগলিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়। এদের অনেকেই স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেলে শিক্ষার্থী হারানোর ভয় করছে। ইউজিসি সংশ্লিষ্টরা বললেন, আজ হোক কাল হোক বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতেই হবে। যত আগে স্থানান্তর করা হবে, তত তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও স্থায়ী ক্যাম্পাসমুখী করা যাবে।