রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সংস্থার (বিআরটিসি) ডিপোগুলো নষ্ট গাড়ির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ডিপোগুলোতে মেরামত অযোগ্য পরিত্যক্ত গাড়িতে ভরপুর। দুর্নীতি-অনিয়মের মাধ্যমে কেনা ওসব বাস ঘোষিত লাইফ টাইমের এক-তৃতীয়াংশ সময়ের মধ্যেই অকেজো হয়ে পড়েছে। মূলত অবহেলা আর কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবেই কোনো বাস অচল হয়ে ডিপোতে গেলে সেটি আর রাস্তায় ফিরে আসে না। ফলে সরকারি সংস্থাটির মোট বাসের এক-তৃতীয়াংশের বেশি অচল হয়ে পড়েছে। বিআরটিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত দুই দশকে বিআরটিসিতে যেসব গণপরিবহন কেনা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ভলবো দ্বিতল বাসগুলো ছাড়া বাকি সবই নি¤œমানের। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ওসব বাস লক্কড়ঝক্কড় অবস্থায় ডিপোতে ঠাঁই নিয়েছে। আর ভলবো বাসগুলোও কার্যকর রক্ষণাবেক্ষণ না করে নির্ধারিত লাইফ টাইমের আগেই বিকল করে ডিপোবন্দি করা হয়। সম্প্রতি বিআরটিসি বিভিন্ন ডিপোতে অচল হয়ে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে ১২৯টি গাড়ি নিলামে বিক্রি করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে দোতলা ভলবো বাস, দোতলা বাস, একতলা বাস, ট্রাক, কার ও অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। মূলত অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বিপুলসংখ্যক যাত্রীবাহী বাসের বহর নিয়েও লোকসানের ঘানি টানছে বিআরটিসি। লুটপাটের পথ প্রশস্ত করতে গত কয়েক বছরে চীন, কোরিয়া ও ভারত থেকে কেনা হয়েছে একের পর এক নি¤œমানের বাস। বছর না যেতেই সেগুলো অচল হয়ে ডিপোতে পড়ে থাকছে। পাশাপাশি বাড়ছে মেরামত খরচ। ফলে সংস্থাটিকে লাভের বদলে লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিআরটিসির বহরে বর্তমানে বাস রয়েছে ১ হাজার ৩৮৯টি। তার মধ্যে কমবেশি ৫২৫টিই অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। ওই হিসাবে বিআরটিসির বহরে থাকা বাসগুলোর ৩৮ শতাংশ অচল অবস্থায় রয়েছে। ওসব অচল বাসের অধিকাংশই গত ১০ বছরে কেনা।
সূত্র জানায়, গত এক দশকে নতুন বাস-ট্রাক কেনায় বিআরটিসির মাধ্যমে সরকার খরচ করেছে ১ হাজার ৬১২ কোটি টাকা। ওই বিপুল বিনিয়োগের পরও লুটপাটে বিপর্যস্ত হয়ে আছে বিআরটিসি। নি¤œমানের গাড়ি কেনার দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় ২০০৯ সালে চীন থেকে ১২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকায় কেনা হয় ২৭৯টি বাস। অভিযোগ রয়েছে, টাকার অঙ্ক বেশি দেখানো হলেও কম টাকায় কেনা নি¤œমানের বাসগুলোর বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। মূলত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুই বছরের মাথায় ওসব বাস নষ্ট হতে শুরু করে। এখন চলাচলের একেবারেই অযোগ্য ১৬০টি বাস। চীনের পর ২০১১-১২ অর্থবছরে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২৮১ কোটি টাকায় কেনা হয় আরো ২৫৫টি বাস। সেগুলোরও বেশির ভাগই নষ্ট হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে রয়েছে। প্রতিটি বাসের দাম পড়ে কোটি টাকার বেশি। অথচ ৬ বছর পার না হতেই ৮১ বাস নষ্ট হয়ে যায়। সেগুলো এখন মেরামতেরও উপযোগী নয়। ২০১৩ সালে ভারত থেকে ঋণ নিয়ে কেনা আর্টিকুলেটেডসহ ৪২৮ বাসের একটি বড় অংশ বিকল হয়ে গেছে। বিআরটিসির প্রতিটি ক্রয় চুক্তি, বাস সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণে রয়েছে সীমাহীন অনিয়ম।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১২-১৩ সালে ১০০ কোটি টাকায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড এবং ৮৮টি এসি বাস কেনে বিআরটিসি। শুরুতে ওসব বাসের আয়ু ১৫ বছরের বেশি বলা হলেও মাত্র দুই-তিন বছরের মধ্যেই বাসগুলো নষ্ট হতে থাকে। একেকটি আর্টিকুলেটেড বাসের দাম ১ কোটি ১১ লাখ টাকা। বর্তমানে ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাসের ২০টির বেশি অচল হয়ে বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে আছে। আরো ১৫/১৬টি বাস জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সেগুলো যে কোনো সময় অচল হয়ে যেতে পারে। ৫৪ ফুট দীর্ঘ জোড়া লাগানো ওসব বাস এখন কেবল রাজধানীর দুটি রুটেই চলাচল করছে। এই বাসগুলো বর্তমানে নির্মাণাধীন গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটের বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের জন্য কেনার কথা ছিল। কিন্তু কোটি টাকার বেশি মূল্যের ওসব বাস লুটপাটের জন্য বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরুর অনেক আগেই কেনা হয়। তাছাড়া সুইডেন থেকে কেনা ৫০টি ভলবো দ্বিতল বাসের সবগুলোই বিকল হয়ে পড়েছে। তার মধ্যে গাজীপুরে বিআরটিসির কেন্দ্রীয় বাস মেরামত কেন্দ্রে রয়েছে ২৩টি আর মিরপুর ডিপোতে রয়েছে ২৭টি। ওসব বাসের ক্রয়মূল্য প্রায় ৫২ কোটি টাকা। ঋণের টাকায় কেনা ওসব বাস না চললেও সরকারকে সুদসহ ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে- ইচ্ছাকৃত অবহেলায় ওসব বাস নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিগত ১৯৯১ সালে বিআরটিসি সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) টাকায় ৫০টি দ্বিতল বাস কেনার প্রকল্প হাতে নেয়। সিডা এ প্রকল্পে ৬১ কোটি টাকা অর্থায়ন করে। তবে তার মধ্যে অর্ধেক ছিল ঋণ ও বাকি অর্ধেক অনুদান। প্রতিটি বাসের জন্য তখন মূল্য ধরা হয় ১ কোটি ৩ লাখ টাকা। ওই হিসাবে ৫০ বাসের মূল্য দাঁড়ায় ৫২ কোটি টাকা। বাকি ৯ কোটি টাকা রাখা ছিল বাসগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। ওই কোটি টাকার ভলবো বাসগুলোর প্রতিটি এখন মাত্র চার লাখ টাকা করে নিলামে বিক্রির চেষ্টা চলছে।
এদিকে এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামসুল হক জানান, অবহেলায় জনগণের মূল্যবান সম্পদগুলো নষ্ট করে ফেলা হলো। সরকারি ছত্রছায়ায় থাকা কিছু সুবিধাভোগী বাসগুলোকে নষ্ট করেছে। জনগণকে সেবা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা জনগণের টাকা পানিতে ফেলেছে। সঠিকভাবে মেরামত করা হলে জনগণের সেবায় আরো ২৫ থেকে ৩০ বছর ভলবো বাসগুলো সার্ভিস দিতে পারতো। ভলবো বাসের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছিল ১৫ বছর। প্রতিটি বাস ৬ হাজার কিলোমিটার চালানো ও ৭ লাখ ২০ হাজার যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল। কিন্তু ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বাসে বছরে যাত্রী পরিবহন করা হয় ৩ লাখ ১৪ হাজার ৮০০ জন। নষ্ট হওয়ার পর সেগুলোর যন্ত্রাংশ সময়মতো লাগানো হয়নি। ফলে ব্যবহারের ৮ বছরের মধ্যেই পরিত্যক্ত ও নষ্ট হয়ে যায় বাসগুলো। তারপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব ভলবো বাস মেরামতের জন্য বিশেষভাবে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও সে টাকা অন্য বাস মেরামতের নামে লোপাট করেন বিআরটিসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সব মিলিয়ে বিআরটিসির রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, জোয়ারসাহারা, মতিঝিল, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, রংপুর, বগুড়া, নরসিংদীসহ বিভিন্ন ডিপো এখন নষ্ট বাসের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।