জলাশয়ের হ্রাস, ভয়াবহ দূষণসহ নানা কারণে দেশে পানযোগ্য পানির সংকট দিনদিন বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশে পানি কিনে পান করতে হবে -নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এমন চিন্তা কেউ করেনি। অথচ দেশের মানুষকে এখন টাকা দিয়ে পানি কিনে খেতে হচ্ছে। কিন্তু এটা শুধু রাজধানীতেই। এর বাইরেও সারাদেশে রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট আর আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের দুই কোটির মত মানুষ। যদিও এই সমস্যার সমাধানে গত কয়েক বছরে দেশ জুড়ে কয়েক লাখ নলকূপের অর্সেনিক মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। বসানো হয়েছে আর্সিনিকমুক্ত গভীর নলকূপ। তারপরও আর্সেনিককে দেশের প্রধান স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘের সহযোগী সংগঠন হিউমেন রাইটস ওয়াচ।
এদিকে চলতি মাসের শুরুতে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ‘ডিটেকটিং এ লিথাল পয়জন ইন ড্রিংকিং ওয়াটার’ শীর্ষক একটি ভিডিও প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, প্রায় ৪ কোটি বাংলাদেশি আর্সেনিক ঝুঁকিতে রয়েছে। কীভাবে আর্সেনিকমুক্ত খাবার পানি নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা করে একদল বিজ্ঞানী সঠিক সমাধানের পথ বের করেছে। তারা বলছে, এ বিষয়ে সবার আগে স্থানীয় মানুষদের সচেতন করতে হবে। বিশুদ্ধ খাবার পানির মান সম্পর্কে মানুষের মধ্যে বোঝাপড়া থাকতে হবে। বিজ্ঞানীরা একটি কিট আবিষ্কার করেছে যার মাধ্যমে সহজেই পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ণয় করা যায়। কিন্তু এই কিটের মূল্য সস্তা নয়। তাই জাতিসংঘের শিশু তহবিল সংস্থা বা ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে বিনামূল্যে এ সেবা দিচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গত ৭০ এর দশকে বাংলাদেশে কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব থেকেই তখন কলেরার জীবাণু সংক্রমিত হয়ে মানুষের প্রাণহানি ঘটায়। ওই ঘটনার পর থেকে বিশুদ্ধ পানির জন্য দেশজুড়ে নলকূপ ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। এই পদ্ধতিতে মাটি ভেদ করে, যেখানে পানির স্তর রয়েছে সেখান থেকে পানি টেনে তোলা হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে পানি তুলতে গিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় পানির সঙ্গে আর্সেনিকও চলে আসে। কারণ হচ্ছে, মাটি ভেদ করতে গিয়ে যেখানে আর্সেনিকের স্তর রয়েছে তাও ভেদ করা হয়, এতে পানির সঙ্গে আর্সেনিক চলে আসে।
এদিকে, হিউমেন রাইটস ওয়াচ’র প্রকাশিত এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দেশটিতে প্রতিবছর আর্সেনিকজনিত রোগে মারা যাচ্ছে ৪৩ হাজার মানুষ। এছাড়া ক্যান্সার, ত্বকের ক্ষয়, হৃদরোগ ও ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছে আরো কোটি কোটি মানুষ। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের দেয়া হিসাব মতে ২০০০-২০০৩ সালের মধ্যে গ্রামগুলোতে ৫ লাখের মত নলকুপে আর্সেনিক পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। তখন আর্সেনিক মুক্ত নলকুপগুলোকে সবুজ ও আর্সেনিকযুক্তগুলোকে লাল রং দেয়া হয়েছিল। ২০০৩ সালের আগে বাংলাদেশের ২ কোটির মত মানুষ আর্সেনিক মেশানো পানি পান করত। কিন্তু সম্প্রতি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, এখনো বাংলাদেশের ৪ কোটি মানুষ অনিরাপদ বা আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে।
দেশের অনেক স্থানেই গভীর বা অগভীর নলকূপের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ২০ শতাংশ টিউবওয়েলে আর্সেনিকের উপস্থিতি রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৭৮ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পান করে, বাকি ২২ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। প্রতিবছরই পানিবাহিত রোগের কারণে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে অনেকে মারাও যায়। এইচআরডব্লিও’র গবেষকদের মতে, গ্রামাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষকে আর্সেনিক মেশানো পানি পান থেকে বিরত রাখতে বাংলাদেশ সরকার কোনো মৌলিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও সরকার এমন ভাব করছে যেন তারা এই সঙ্কটের সিংহভাগই সমাধান করে ফেলেছেন। কিন্তু এই সমস্যার সমাধানে সরকার যদি তৎপর না হয় এবং আন্তর্জাতিক দাতারা যদি এতে সহায়তা করতে ব্যর্থ হয় তবে দেশটির লাখ লাখ মানুষ আর্সেনিক সংক্রান্ত রোগে মারা যাবে।
অন্যদিকে, দেশের নদীগুলোতে প্রবাহ কমে যাওয়ায় ভাটার টানে প্রতিবছরই বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। শুধু লবণই নয় -নানাভাবে নদী, খাল, বিলের পানি দূষিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা ব্যবহারেরও অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ফলে এসব এলাকার মানুষের স্বাস্থ্যই শুধু ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে না, পাশাপাশি নদ-নদী-হাওর-বাঁওড়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষের জীবিকাও হুমকির মধ্যে পড়ছে। পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিম উপকূলীয় ১৩টি জেলার ছয়টির সুপেয় পানির সংকট সব থেকে তীব্র। এগুলো হলো খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও বরগুনা। এই এলাকাগুলো ব-দ্বীপের নিম্নভাগে হওয়ায় ভূগর্ভে জলাধারের জন্য উপযুক্ত মোটা দানার বালু বা পলিমাটির পরিবর্তে নদীবাহিত অতি সূক্ষ্ম দানার বালু ও পলি বেশি দেখা যায়। যে কারণে এসব অঞ্চলে ভূগর্ভেও পানযোগ্য পানি পাওয়া যায় না। কোনো কোনো অঞ্চলে ৯০০ থেকে এক হাজার ফুট গভীরে কখনো কখনো সুপেয় পানি পাওয়া যায়।
খুলনার পাইকগাছা, কয়রা ও দাকোপ; সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর, কালীগঞ্জ ও দেবহাটা; বাগেরহাটের মংলা ও শরণখোলা; পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া, বরগুনার পাথরঘাটা এবং পটুয়াখালীর গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলায় গভীর নলকূপ বসিয়েও মিষ্টি পানি পাওয়া যায় না। এছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নদীর নাব্যতা হ্রাস, খরা এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বেড়েছে সুপেয় পানির সংকট। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূগর্ভের পানির ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পুনর্ভরণের (রি-ফিল) সমস্যা। যে পরিমাণ ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে, আনুপাতিক হারে সেই পরিমাণ পানি আবার ভূগর্ভে যাচ্ছে না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি নদী-খাল দখল, ভরাট ও দূষণরোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে সুপেয় পানির সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে সতর্ক করছেন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।