নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ আশাব্যঞ্জক উন্নতি করলেও এখনো বাল্যবিয়ে বন্ধে কাক্সিক্ষত সাফল্য আসেনি। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে সংঘটিত হয় বাংলাদেশে যা আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি মারাত্মক ভাইরাসের নাম। বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও পবিত্র বন্ধন, তবে বাল্যবিয়ে দেশ ও জাতির জন্য অভিশাপ। আমাদের যাপিত জীবনে আধুনিকতা ও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও বাল্যবিয়ের প্র
শের বিভিন্ন প্রান্তে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বাল্যবিয়ে, যা গ্রাম গন্ডি পেড়িয়ে সারাদেশে ব্যাধির মতো ছড়াধচ্ছে এই সমস্যা। বাল্যবিয়ে শুধু দারিদ্র্য, অল্প শিক্ষিত পরিবারেই ঘটছে তা নয়, অনেক শিক্ষিত পরিবারেও ঘটছে হরদম। বাবা-মার অসচেতনতামূলক দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার বাসনা এই বাল্যবিয়ে, যার জন্য ধ্বংস হয় একটি মন, একটি পরিবার, একটি সমাজ, সর্বোপরি একটি রাষ্ট্র। আর বর্তমান পৃথিবী হারাচ্ছে আগমীর পৃথিবীকে এবং দেশ হারাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশ গড়ার হাতিয়ার। এক কথায় বলা যায় বাল্যবিয়েতে পুড়ছে দেশের ভবিষ্যৎ।
আমাদের দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গড়তে হলে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতেই হবে। এই জন্যে রাষ্ট্র ও জনতার ঐক্যবন্ধতার দরকার। আমরা জানি, বাল্যকাল বা পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পূর্বে যে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাকে বাল্যবিয়ে বলে। বাল্যবিয়ে মানেই অন্ধকারে আবদ্ধ হলো যেন তাদের জীবন। বাল্যবিয়ের শিকার ছেলেমেয়ের শিক্ষা স্বাস্থ্য বিনোদনের মতো মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় যা তাকে সারাজীবনের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত করে। ইউনিসেফের একটি জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ বৎসর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। বাল্যবিয়ের বিভিন্ন কারণ লক্ষ্য করা যায়। তার প্রধান কারণ দারিদ্র্যতা, নিরক্ষতা, সামাজিক চাপ, নিরাপত্তার অভাব, যৌন নির্যাতন, যৌতুক প্রথা, ইভটিজিং অশিক্ষা, অসচেতনতা, বোঝাস্বরূপভাব, অর্থাভাব, কুসংস্কার, অপরিণত বয়সে প্রেমে জড়িয়ে পড়া, অবহেলা, পুরোনো ধ্যানধারণা, বেকারত্ব, প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা, পারিবারিক ভাঙন ও অবক্ষয়, প্রশাসনের ব্যর্থতা ইত্যাদি। আজকের শিশু ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। বাল্যবিয়ে পরিমাণ না কমালে, নারীর প্রতি সহিংসতা, মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি, অপরিণত গর্ভধারণ, প্রতিবন্ধী সন্তান জন্ম দেয়া, অপুষ্টি জনিত সমস্যা, প্রসবকালীন শিশু মৃত্যুর ঝুঁকি, প্রসবকালীন খিচুনি, প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা, মানসিক অশান্তি, বিয়ে বিচ্ছেদ, পরকীয়া, আত্মহত্যা, জরায়ুর ক্যান্সার, ও নবজাতকের বিভিন্ন রোগ হওয়ার সম্ভাবনা, অপরিকল্পিত পরিবার, দাম্পত্য কলহ, পতিতাবৃত্তি, নারীর শিক্ষার হার হরাস, স্কুল থেকে ঝড়ে পড়ার হার বৃদ্ধি, নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার ক্ষমতা ও সুযোগ কমে যাওয়াসহ নানানবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকবে। বাল্যবিয়ে নির্মূল করা কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণগুলো চিহ্নিত করে এবং বাবা মার সদিচ্ছাই পারে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে। বাল্যবিবাহ বন্ধে গত বছরের ১২ এপ্রিল চালু হয়েছে সরকারি হটলাইন নম্বর ৩৩৩। এই নম্বরে দেশের যেকোনো জায়গা থেকে বাল্যবিবাহের তথ্য জানানো যায়। তথ্য পাওয়ার পর হটলাইনটির সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধি ওই তথ্য সংশ্লিষ্ট থানা বা জেলা প্রশাসনকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দেন। তারপর স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ত্বরিত ব্যবস্থা নেন। যা গ্রামঞ্চলের সচেতন অসচেতন মানুষ গুলো জানেনা,তাই এর প্রচার করতে হবে গুরুত্বপূর্ণ সহকারে। শুধু তাই নয় স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া, গণমাধ্যম পত্র-পত্রিকায় আন্দোল গড়ে তোলা। বাল্যবিয়ে বন্ধে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মেম্বররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বাল্যবিয়েরোধে যুবকদের নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে, প্রশাসন মাইক এর মাধ্যমে প্রতিটি ইউনিয়ন এবং গ্রামে বাল্যবিয়ের শাস্তি কী হতে পারে তা যদি প্রচার করতো, তাহলে অনেক বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হতো। বাবা-মার পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে কাজিরা যদি টাকার কাছে হার না মেনে শপথ নিতো তাহলে বাল্যবিয়ে নির্মূল করা সম্ভব হতো। অবশেষে আমি অনুরোধ করি সকল বাবা-মাকে আসুন, আমাদের দেশের সরকার, দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগঠন, আপোষহীনভাবে বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছে। আমরা তাদের সাথে সামিল হই। এবং বলি আমার মেয়ের বিয়ে আঠারো বছরের আগে নয়, আঠারো বছর পরে হলে ভালো হয়। আমরা বাল্যবিয়ে বন্ধ করবো, সোনার বাংলাদেশ গড়তে সন্তানকে সহযোগিতা করবো, কন্যাসন্তান মানেই বোঝা নয়, করবে তারা বিশ্ব জয়।