বিনাচাষে বরজের মাধ্যমে বিষমুক্ত উপায়ে “বাংলাপান” জাতের পান চাষ করে অধিক লাভবান হচ্ছেন কুষ্টিয়ার কৃষকরা। আধুনিক উপায়ে এ জাতের পান চাষ করে বিঘাপ্রতি এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ করছেন কৃষকরা। কয়েক বছর পূর্বেও যেখানে অধিক আর্থিক লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষে ঝুঁকেছিলো, এখন তারা তামাকের পরিবর্তে অধিক লাভবান অর্থকারী ফসল এ পান চাষে ঝুঁকছে। অর্থকারী ফসল ছাড়াও পানের ভেষজ গুণাবলীর কারণে রয়েছে পানের চাহিদা। এ ছাড়া বাংলার ঐতিহ্যে বিয়ে বাড়ীর অনুষ্ঠানে ও পূজা-পার্বনেও রয়েছে পানের কদর।
কুষ্টিয়ার মাটি পান চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় এবং পানের বাজার দর ভালো থাকায় পান চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন কৃষকরা। অন্যান্য ফসলের তুলনায় পানে লাভও বেশি হয়। বাজারের চাহিদার কথা চিন্তা করে, মাটি ও মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দিকে নজর দিয়ে নিরাপদ পান উৎপাদনে কৃষি অফিস সহায়তা করছেন কৃষকদের। প্রদর্শনী, মাঠ দিবস, প্রশিক্ষনের মাধ্যমে বিষমুক্ত উপায়ে পান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে কৃষি অফিস।
কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় ২ হাজার ১শ ৪০ হেক্টর জমিতে পান চাষ করা হয়েছিলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পান চাষ হয়েছিলো ভেড়ামারা উপজেলায়। ভেড়ামারা উপজেলায় ৭শ ২০ হেক্টর, দৌলতপুর উপজেলায় ৫শ ৩৬ হেক্টর, কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৬শ ২০ হেক্টর, মিরপুর উপজেলায় ১শ ৬০ হেক্টর, খোকসা উপজেলায় ৮২ হেক্টর এবং কুমারখালী উপজেলায় ২২ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছিলো। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে পান চাষ বৃদ্ধি পেয়ে চাষ হয়েছিলো ২ হাজার ১শ ৬৫ হেক্টর। এর মধ্যে ভেড়ামারা উপজেলায় ৭শ ৫০ হেক্টর, দৌলতপুর উপজেলায় ৫শ হেক্টর, কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় ৬শ ২০ হেক্টর, মিরপুর উপজেলায় ২শ ১০ হেক্টর, খোকসা উপজেলায় ৭০ হেক্টর এবং কুমারখালী উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে পান চাষ হয়েছিলো।
বাংলা পান, মিঠা পান, দেশী পান, ঝালি পান, সাচি পান, কর্পূরী পান, গ্যাচ পান, মাঘি পান, উজানী পান, নাতিয়াবাসুত পান, বরিশাল পান, উচ্চ ফলনশীল ও বিভিন্ন গুণাবলী সম্পন্ন এবং রোগ প্রতিরোধে সক্ষম বারিপান-১, বারিপান-২ এবং বারিপান-৩ ছাড়াও বেশ কয়েকটি পান বাংলাদেশে চাষ করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাংলা পান ও মিঠা পান জনপ্রিয়। কুষ্টিয়া অঞ্চলে এ বাংলা পান চাষে আগ্রহ বেশি কৃষকদের।
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, দৌলতপুর ও মিরপুরে এ বাংলা পানের চাষ বেশি হয়ে থাকে। স্বাদ ও সুগন্ধিযুক্ত এ জাতের পানের বাজারে রয়েছে বেশ চাহিদা। এ ছাড়া বাংলাপান পাতা পঁচা, পাতা পোড়া ও অন্যান্য রোগ প্রতিরোধক্ষম হওয়ায় কৃষকরা এ পান চাষে বেশি ঝুঁকছে।
ভেড়ামারা উপজেলার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ঠাকুর দৌলতপুর এলাকার পান চাষী আবদুর রহমান জানান, আমি দীর্ঘদিন ধরেই পান চাষ করি। তবে পানের বিভিন্ন রোগে পানে খুব একটা লাভ হতো না। পরে আমি উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমি নিরাপদ উপায়ে পান চাষের উপরে প্রশিক্ষন নিয়ে দুই বিঘা জমিতে “বাংলাপান” জাতের পানের চাষ করছি। আমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নিরাপদ পান উপাদন করছি। দুই বিঘা জমিতে আমার প্রায় দুই লক্ষ টাকা লাভ হবে বলে আশা করছি।
মিরপুর উপজেলার বারুইপাড়া ইউনিয়নের ফকিরাবাদ এলাকার পান চাষী শহিদুল ইসলাম জানান, আমি আগে তামাক চাষ করতাম। তবে এখন আর তামাক চাষ করি না। বর্তমানে আমি পান চাষ করি। আমি গত বছর এক বিঘা জমিতে বাংলাপানের চাষ করেছিলাম। সেখানে আমার প্রায় এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাভ হয়েছিলো। প্রথমবার পানের বরজ করতে একটু বেশি খরচ হয়। কিন্তু পরের বার চাষ করতে খরচ কম। এবছর আমি তিন বিঘা জমিতে বাংলাপানের চাষ করেছি। প্রায় দুই লাখ টাকার উপরে পান বিক্রি করেছি। এখনো ২-৩ লাখ টাকার বিক্রি হবে।
তিনি আরো জানান, স্থানীয় বাজার, কুষ্টিয়া, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ বাংলাপানের চাহিদা বেশি থাকায় আমরা সেখানে রপ্তানি করি।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, অর্থকারী ফসলের মধ্যে পান একটি লাভজনক ফসল। ইতিপূবে কুষ্টিয়ার পান সারা দেশের মধ্যে বিখ্যাত ছিলো। তবে বিগত কয়েক বছর আগে পানের বিভিন্ন রোগের কারণে পান চাষীদের লোকসান হয়। এতে পান চাষ অনেকটা কমে যায়। পরবর্তীতের আমরা পান উৎপাদন ও সম্প্রসারণ কর্মসূচির আওতায় পান চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করি। সেই সাথে নিরাপদ উপায়ে পান চাষের উপরে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষন প্রদান করি। এতে কৃষকরা পান চাষে লাভবান হয়। ফলে এই এলাকায় এবছর আরো ৩০টি পানের বরজ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সাথে চাষীরা ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে পান চাষীরা লাভবান হচ্ছেন।
তিনি আরো জানান, এ উপজেলা থেকে আশা করছি এ বছর দেশের বাইরেও পান রপ্তানি করা হবে।
কুষ্টিয়া জেলা কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) কৃষিবিদ রঞ্জন কুমার জানান, পান চাষ অত্যধিক লাভজনক। এ ছাড়া বাজারে বাংলাপানের চাহিদা বেশি। তাই কুষ্টিয়ার কৃষকরা এ বাংলাপানের চাষ করছে। আমরা নিরাপদ পান উৎপাদন প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষকদের পান উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করছি। এতে আমরা নিরাপদ পান উৎপাদন করছি। এ ছাড়া বিষ মুক্ত এ পান আমরা আবারো বিদেশে রপ্তানির চেষ্টা করছি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরোজমিন উইং এর পরিচালক কৃষিবিদ চন্ডীদাস কুন্ডু বলেন, পান একটি অর্থকারী ফসল। পানের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনান্য ফসলের তুলনায় কোনো অংশে কম নয়। দেশে বিদেশে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। এছাড়াও এতে অনেক ঔষধি গুণ বিদ্যমান। এক বিঘা জমিতে পান চাষ করে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা লাভ করা যায়। এটা তামাক, পাট এর চেয়ে অধিক লাভবান। আর বিষমুক্ত পান বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।