যাত্রা শুরু হলো অত্যাধুনিক ও স্বয়ংক্রিয় গ্রিনটি ফ্যাক্টরী’র। ২৬ সেপ্টেম্বর শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষনা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) ক্যাম্পাসে নবনির্মিত এই গ্রিনটি ফ্যাক্টরী’র আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আল মুস্তাহিদুর রহমান পিএসসি এর উদ্বোধন করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চা গবেষনা কেন্দ্রের পরিচালক ড. মোহাম্মদ আলী এবং প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক একেএম রফিকুল হক প্রমুখ।
চা একটি জনপ্রিয় পানিয় এবং বাংলাদেশের একটি গৌরবময় কৃষিজ পণ্য। শুধু বাংলাদেশেই নয়, চা বিশে^র জনপ্রিয় পানিয়ের অন্যতম। চা-এক জাদুকরী বৃক্ষ যা চা গাছের কচি পাতার নির্যাসজাত পানি দ্বারা সমগ্র বিশ^কে বিমোহিত করে রেখেছে যুগের পর যুগ। ধারনা করা হয়ে থাকে চীনেই চা গাছের আদি নিবাস।
চা বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। কিছুদিন পূর্বেও আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের চা বলতে সাধারণত ব্ল্যাক টি দিয়ে তৈরি দুধ চা, লিকার চা ও আদা চা হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। কিন্তু অক্সিডেশন প্রক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে চায়ের যে চারটি প্রকারভেদ যেমন: ব্ল্যাক টি, গ্রিনটি, উলং টি ও হোয়াইট টি এ বিষয়ে তেমন কোন ধারনা ছিল না। বর্তমানে অনেক ধরনের চা বাজারজাত করা হচ্ছে।
চীন ও জাপানে গ্রিনটি’ই প্রধান পানিয়। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশেও গ্রিনটি’র চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পুষ্টিগুনে ভরপুর এই গ্রিনটি। এটি ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা দূর করতে ও শরীরের বাড়তি ওজন কমিয়ে স্লিম করতে সহায়তা করে। শরীরের খারাপ কোলেষ্টেরলের পরিমাণ কমায়, মুখের ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করে, বার্ধক্যজনিত হাড় ক্ষয়ের পরিমাণ কমায়, দাঁতের ক্ষয়রোধ করে ও ত্বক ভালো রাখতে সহায়তা করে।
সূত্র জানায়, চা নিয়ে নানামুখী গবেষনাকারী দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান শ্রীমঙ্গলের বাংলাদেশ চা গবেষনা ইনস্টিটিউট গ্রিনটি’র গুনগত মান অক্ষুন্ন রেখে উন্নতমানের গ্রিনটি কিভাবে উৎপাদন করা যায়, কিভাবে ভালো মানের গ্রিনটি উৎপাদন করে দেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়- এ নিয়ে গবেষনা কার্যক্রম চালানো হবে। অত্যন্ত উন্নতমানের গ্রিনটি উৎপাদন করে দেশের অভ্যন্তরীন চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানির বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করছে চা বোর্ড।
অত্যাধুনিক এই গ্রিনটি ফ্যাক্টরীতে গুনগতমান অক্ষুন্ন রেখে অত্যন্ত উন্নতমানের সেরা গ্রিনটি তৈরি করতে শুধুমাত্র চা গাছের কচি পাতা অর্থাৎ কেবলমাত্র চা গাছের অগ্রভাগের দুটি পাতা একটি কুঁড়ি ব্যবহার করা হবে।
জানা যায়, ৩ কোটি ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে চায়নার গ্রিনটি ফ্যাক্টরী মেশিনারীজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নিংপো ইয়াও চিয়াং-ইউয়ান কোম্পানি থেকে মেশিনারীজ আমদানি করা হয়। এ ছাড়া ভবন নির্মাণে ব্যয় হয় ১ কোটি ৫৫ লাখ ৭১ হাজার টাকা। এতে সর্বমোট ব্যয় হয়েছে মোট ৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক ট্রায়াল শেষে গত ১ জানুয়ারী মেশিনারীজ সমূহের হস্তান্তর-গ্রহন প্রক্রিয়া সম্পন্য হয়। তারপর শুরু হয় পরীক্ষামূলক উৎপাদন। পরীক্ষামূলক উৎপাদন সফল হওয়ায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
চা বোর্ড বলছে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে অত্যাধুনিক গ্রিনটি ফ্যাক্টরী। এই ফ্যাক্টরী থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গুনগতমান অক্ষুন্ন রেখে উন্নতমানের গ্রিনটি উৎপাদন করা যাবে। ১১৩৭ বর্গ মিটার জায়গার উপর প্রতিষ্ঠিত এই ফ্যাক্টরী ভবনটিতে যন্ত্রপাতি ছাড়া ৬টি কক্ষ রয়েছে। যেমন- অফিস কক্ষ, উইদারিং কক্ষ, রক্ষনাবেক্ষন কক্ষ, জীবানুমুক্তকরন কক্ষ, প্যাকেজিং কক্ষ ও সংরক্ষণ কক্ষ।
চা বোর্ড সূত্র জানায়, অটোমেশনের জন্য এই ফ্যাক্টরী’র মেশিনারীজ সমূহে প্রোগ্রামেবল লজিক কন্ট্রোলার ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছে ফলে এনার্জি সেভের পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাত প্রক্রিয়া অনেক নিখুতভাবে সম্পাদন করা যাবে। তাছাড়া ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক হিটিং সিস্টেম থাকায় শতকরা ৪০ শতাংশ এনার্জি কম খরচ হবে। এখানে ছোট-বড় ১৬টি মেশিনের মাধ্যমে গ্রিনটি প্রক্রিয়াজাত করা হবে। প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ মেশিনে ডিসপ্লেসহ ডিজিটাল কন্ট্রোল সিস্টেম বিদ্যমান রয়েছে। প্রক্রিয়াজাতকরনের ১ম ধাপ ফিডারে সবুজ পাতা সরবরাহ করার পর হাতের স্পর্শ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রায় সাড়ে ৪ ঘন্টায় প্রক্রিয়াজাত গ্রিনটি বের হয়ে আসবে। এই ফ্যাক্টরীতে প্রধানত ২ ধরনের গ্রিনটি প্রক্রিয়াজাত করা যাবে। সেগুলি হলো- ওয়্যারী গ্রিনটি ও কার্লী গ্রিনটি।
বর্তমানে এই গ্রিনটি প্রসেসিং ইউনিটের মাধ্যমে ঘন্টায় প্রায় ২০০ কেজি সবুজ পাতা ফিডিং করা যাবে। সে অনুযায়ী দৈনিক ৮ ঘন্টা সবুজ পাতা ফিডিং করা হলে মোট ১৬০০ কেজি সবুজ পাতার প্রয়োজন হবে এবং দৈনিক উৎপাদিত গ্রিনটি’র পরিমাণ দাড়াবে প্রায় ৩২০ কেজি। সেই হিসেবে এই ফ্যাক্টরীতে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার কেজি গ্রিনটি উৎপাদন করা সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চা বোর্ড জানায়, উৎপাদিত গ্রিনটি অকশনের মাধ্যমে ও বাংলাদেশ চা বোর্ডের চা প্রদর্শন ও বিক্রিয় কেন্দ্রগুলোতে বিক্রয় করা হবে। চা প্রদর্শন ও বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে বিভিন্ন আকৃতির প্যাকেট ও কনটেইনারে বিভিন্ন পরিমানে এই চা প্যাকেটজাত করে রাখা হবে। প্রাথমিকভাবে প্রতি কেজি গ্রিনটি’র মূল্য ধরা হয়েছে ২০০০ হাজার টাকা।