অজপাড়া গায় এই রেলষ্টেশনটি। ছোট্ট এলাকা । দু’টো রেল লাইন । একটি যাওয়ার আরেকটি আসার রাস্তা। ঢাকা থেকে সব ট্রেন এই রাস্তা দু’টো দিয়েই আসা যাওয়া করে। এরপর দু’ভাগ-ই চলে যায় যেখানে যেতে চায় সেখানে। ছোট্ট একটি ষ্টেশন, কিন্তু তবুও সবসময় কোলাহল লেগেই আছে ষ্টেশনে। নিয়মিত বিরতিতে একটার পর একটা ট্রেন আসছে আর ছুটে যাচ্ছে। কত রকমের মানুষ ষ্টেশনে আসে তার কোন হিসেব নাই । অনেক হকার , ফকির, ছদ্দবেশী পুলিশের লোক এবং নানামুখী যাত্রী তো আছেই। সেই সাথে এই ষ্টেশনে অনেক দিন যাবত আছে একটা বিড়াল। বয়স আট দশ বছরতো হবেই। গলার স্বর অস্বাভাবিক চওড়া। গলায় একটা কালো কাপড়ের মালা। সেই মালার তিন পাশে তিনটে ঘুঙুর। তার মাথার পেচানো লাল শালু কাপড়। অনেকে বলে বিড়ালটা বিড়াল না অন্য কিছু। আমি অবশ্য এসব বিশ্বাস করিনা । হ্যাঁ একথা ঠিক মাঝে মাঝে কিছু কথা একেবারে হুবুহ ফলে যায়। তাই বলে তাকে অন্যকিছু বলে মেনে নেয়া যায়না। আর আমার মত লোকের পক্ষে তা কখনোই সম্ভব নয় । কারন আর সবার চেয়ে টিংকিকে আমি সবচেয়ে বেশি জানি। টিংকি এই বিড়ালটারই নাম। আমার দেয়া। আমি আদর করে টিংকি ডাকি। কেননা, বহুদিন আগে আমাদের একটা কিংটি ছিল। ঠিক এই ষ্টেশনের টিংকিটার মতই। তবে সাইজে ছোট ছিল। তারও আগে আমাদের ছিল টুকলু ১, টুকলু ২ এবং টুকলু ৩ নামক তিনটি বিড়াল। এরা সবাই-ই বিভিন্নভাবে স্থান করে নিয়েছে আমার মনে। এখন স্থান করে নিচ্ছে টিংকি। আমি এখানে, এই ষ্টেশনের পাশে এসবি রহমতের বাসায় এসেছিলাম একটি কাজে। যাইহোক এসবি রহমত। এই ষ্টেশনের ষ্টেশন মাস্টার । সে যখন চাকুরী পেয়ে এই লাকসাম ষ্টেশনে আসি এর কিছু দিন পর থেকেই টিংকিকে দেখে আসছে। টিংকর যেমন মায়াবী চোখ তেমন আকর্ষণীয় চেহারা। আমার শৈশবের সেই সময়ের কথা আমার মনে আছে এখনও স্পষ্ট । এছাড়া ছোট বেলা থেকে ডায়েরী লেখার অভ্যাস আমার ছিল। আমি কখন ও নিজের কথা কখনও অন্যের কথা ডায়রির পাতায় লিখি । আমি সবসময় আমার চারপাশের মানুষদের নিয়ে লিখেছি । তাদের সংক্ষিপ্ত একটা পরিচয় এবং তারা কে কি করে । আমার সাংবাদিকতা আর অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি লিখেছি।
একদিনের ঘটনা বলি। আমি বসে আছি একাকী, রাত অনেক হয়েছে। ষ্টেশনে নীরবতা থাকে না মানুষের মুখরিত গুঞ্জনে। কিন্তু রাতের দ্বিপ্রহরে অনেক নীরবতা। কেমন যেন নিরব নিস্তব্দ এই ষ্টেশন।
হঠাৎ করেই সকল নিরবতা ভেঙে ষ্টেশনের গেস্ট হাউসে আসে এসবি রহমত। সাথে সাথে আসে টিংকিও। টিংকির দিকে এক পলকে তাকিয়ে থাকি আমি। আর আমার এই তাকিয়ে থাকা দেখে এসবি রহমত মুখ খোলে। বলা শুরু করে তাঁর বুকে জমিয়ে রাখা কথাগুলো। বলে,
জীবনের বেশীরভাগ সময় আমি এই একাকীত্বকে বুকে নিয়ে বেঁচে থাকি রাতের পর রাত , মাসের পর মাস। এই দুনিয়ায় আমি আমার শেষ প্রজন্ম। আমার পরে আর কেউ নাই। আমার আগে যারা ছিল তারা কেউ এখন বেঁচে নাই । এই পৃথিবীর মাঝে আমার বংশে শুধু আমি বেঁচে আছি। বাবা মারা গেছে মুক্তিযুদ্ধের সময়। রাজাকার সাঈদী তার সাথে করে পাকিস্তানীদের আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে । আমি সেই সময় ভারতের বর্ডারে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছি। রাজাকার সাঈদী বাবাকে আমার কথা জিজ্ঞেস করল। বাবা বলেছিলেন – “ছেলে আমার দেশ স্বাধীন করতে গেছে। তোর মত রাজাকার হয়নি হারামজাদা ” । সাঈদী পাকবাহিনীর মেজর কে কি যেন বলেছিল । তারপর তারা বাবাকে উঠোনে নিয়ে এসে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় তার বুক । পরাধীন বাংলা বাবার সেই রক্ত চুষে মনে মনে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে আরো শক্তিশালী কওে দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তখন আমি যুদ্ধ করি । একদিন এমনি নিশুতি রাতে বাবার মৃত্যে সংবাদ শুনি নূরীর কাছে । সেই নুরী তখন টগবগে তরুনী। আমার তো বাবাকে মেরে সামসু চলে গেছে । কিন্তু নুরীর পরিবারের কাউকে জীবিত রাখেনি সেই হায়না। নুরীর বাবাকে বেনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছে কুত্তার দল। সাথে ছিল আমাদের দেশী একদল নেড়ী কুত্তা। নুরীর ঘটনা আমি যুদ্ধের পর শুনি । তার বোন মালাকে স্কুলের ক্যাম্পে নিয়ে কি নির্যাতন করে। যুদ্ধ শেষে নুরীর বোন মালা গলায় দড়ি দিয়ে আতœহত্যা করে দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি পায় । সেই সময় মালার মত আর অনেকে এভাবে মৃত্যেু বরন করে তার হিসেব নাই। আমার মা বাবার মৃত্যে দেখে আধা পাগল হয়ে গিয়েছিলেন শোকে । যেদিন বাংলাদেশ স্বাধীন হল সেদিন আমি বেশ খুশী মনে বাড়ী ফিরি। আমার মা তখন আমায় বলে, দেশ স্বাধীন করেছিস রে বাপ?
-হ্যা মা ।
-তাহলে তোর বাপকে নিয়ে আয় । বেচারা কোথায় আছে । যা না ।
যুদ্ধ জয়ের আনন্দ সাথে সাথে ক্ষীণ হয়ে যায় । বাবার কথা মনে করে দুচোখ পানিতে ভাসাই । সেই বিকেলে নুরী আসে । এসে সব বলে । আর বলে প্রতিশোধ নিতে হবে , চরম প্রতিশোধ। আমি নুরীকে শান্তনা দিতে চাই । নুরী কি আমার কথা শোনে । ছুটে চলে রাজাকার সাঈদীর খোঁজে। সাঈদীকে পাবে কোথায় সামসু তখন পালিয়ে গেছে গ্রাম ছেড়ে । অনেকদিন সাঈদীর কোন খবর পাইনি । নিজে বিয়ে করলাম পাশের গ্রামের আহমদ মাদবরের মেয়ে সায়রাকে। এরকিছুদিন পর মা মারা গেল বাবার শোকে । আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। সংসার আমার কাছে ভাল লাগেনা। এর মধ্যে সায়রা পোয়াতি হয়। আমি আবার ঘর মুখি হতে থাকি । বর্ষার এক রাতে সায়রার ব্যাথা উঠে । আমি ছুটি অনুর মায়ের খোঁজে। সারা গ্রামে একমাত্র দাঈমা। দাঈমা নিয়ে যখন আসি, তখন সায়রার রক্তে সারা ঘর লাল হয়ে আছে। দাঈমা আমায় বাইরে রেখে ভেতরে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলে বাবা তোর সর্বনাশ হইছে। মা এবং বাচ্চা দুজনকে খোদা তাঁর কাছে নিয়ে গেছে। বুকের মাঝে প্রচন্ড এক ধাক্কা খাই। এরপর রেলের চাকুরীটা পাই। সেই থেকে আর সংসার করিনি । আমি সায়রা ছাড়া কাউকে ভালবাসব তা ভাবতে পারিনা । সায়রা আমার বংশের প্রদীপ জ্বালাতে গিয়ে মরে গেছে তাই আমার ভয় হয়। অনেক বয়স হয়েছে , একদিন আমি ও চলে যাব তখন আর কেউ থাকবে না । আমি অনেকের জন্য কেঁদেছি কিন্তু আমার জন্য কাঁদার কেউ থাকবে না পৃথিবীতে। এটা একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে। আমি যা বেতন পাই তার অর্ধেক রেলের বস্তির এতিম খানায় দিয়ে দেই , বাকীটা দিয়ে আমার পুরো মাস অনায়াসে চলে যায়। লোকজন আমায় অনেক সন্মান করে । কিন্তু তারপর ও আমার কিছু ভাল লাগে না...
এরই মধ্যে টিংকি ছোট মানুষের মত করে বলে ওঠে, আওওও... আ-আ-আ মি... এসবি রহমত বুঝতে পারে টিংকি টয়লেটে যাবে। ব্যবস্থা করে দেয় টিংকির বাইরে যাবার। সেদিন আর কথা হয় না আমাদের চোখে প্রচন্ড ঘুম থাকায় ইতি টানতে হয়, সেদিনের মত।
পরদিন সকালে আবারো আলোকিত সময়ের হাত ধরে দেখা হয় টিংকির সাথে। কিন্তু এসবি রহমত? মনে মনে প্রশ্ন আঁকা শেষ হতেই তাঁর রুমে ছুটে য্ইা। গিয়ে যা দেখি, তাতে আর বুঝতে সমস্যা হয় না যে, আমাকে আবারো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। যাওয়ার সময় টিংকিকে প্রশ্ন করি, যাবি যাবি আমার সাথে? প্রশ্নের পালা শেষ হতেই উত্তর আসে, আ-আ-আ...
আর কথা নয় হাটতে থাকি অজানা গন্তব্যের দিকে। টিংকিও হাঁটতে থাকে আমার পিছে পিছে। রোদের মায়াবী আদরের ভাজে ভাজে ছায়া পড়তে থাকে মাটির গায়। স্ইে ছায়াতে আমি থাকলেও ছিলনা টিংকির ছায়া। তবু আমি হাঁটছি আরেকটি স্বপ্ন স্বদেশ নির্মাণের তাগিদ থেকে। যেমন দেশ গড়তে চেয়েছিলেন ভাসানী, বঙ্গবন্ধু আর শেরেবাংলা...