রাজধানীসহ সারাদেশে সড়ক ও নদীর দখল হওয়া জমি উদ্ধারে দৃশ্যমান অভিযান শুরু হলেও রেলের জমি উদ্ধারে তেমন তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। জানা গেছে, রেলওয়ের প্রায় ৯ হাজার একর জমি বেদখলে রয়েছে। এ জায়গায় অবৈধভাবে বহুতল ভবনসহ মার্কেট পর্যন্ত গড়ে তোলা হয়েছে। বর্তমান সরকার নতুন করে ক্ষমতায় আসার পর রেল, নদী ও সড়কের দখল হওয়া জমি উদ্ধারে ১০০ দিনের বিশেষ কর্মসূচি হাতে নেয়। ফলে সড়ক ও নদীপথে প্রত্যাশিত জমি উদ্ধার হয়। কিন্তু রেলপথের কোনো জমিই উদ্ধার হয়নি। এ বিষয়ে খোদ রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন সংশ্লিষ্টদের ওপর অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, বেদখলে থাকা রেলের জায়গা যে কোনো মূল্যে উদ্ধার করা হবে।
তবে রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, জমি উদ্ধার একটি চলমান প্রক্রিয়া। দখল জমি উদ্ধারে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে সেই অভিযানে কী পরিমাণ জমি উদ্ধার করা হচ্ছে, সেটিও দৃশ্যমান নয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেললাইনের বাইরে থাকা বেশির ভাগ জমিই বেদখলে চলে গেছে। রেলের উদাসীনতায় দখল করা জমি উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে বছরের পর বছর রেলের জমি বেদখলে থেকে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে দখল হওয়া জমির পরিমাণ। তারা বলছেন, রেলের জায়গা দখলকারীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অভিযান শুরু করলেই দখল করা জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে।
রেলের ভূসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে সারাদেশে রেলের মোট ৮ হাজার ৭৮১ একর জমি বেদখলে রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর আনন্দবাজার এলাকায় রেলওয়ের ২.৮৭ একর জায়গা দখলে নিয়ে ৭ তলা পর্যন্ত ভবন নির্মাণ করে মার্কেট গড়ে তোলা হয়েছে। একযুগ ধরে এ জায়গা উদ্ধারে ভূসম্পদ শাখার সংশ্লিষ্টরা তৎপরতা চালিয়ে গেলেও শুধু রাজনৈতিক কারণে জায়গা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু রাজধানী নয়, সারাদেশেই প্রভাবশালীরা এভাবে জমি দখল করে রেখেছে।
রেলওয়ের তথ্যমতে, রেল লাইনের দু’পাশে ১০ ফুট জায়গা খালি রাখার নিয়ম রয়েছে। দু’পাশের দুই ফুট জায়গায় রেল আইন অনুযায়ী সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। সরকারি নির্দেশনা ছাড়াও যে কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো ও বাড়তি সতর্কতার জন্য এমন বিধান রয়েছে। অথচ রাজধানীর মতো দেশের জেলা শহরগুলোর কোথাও খালি জমি রাখার চিত্র দেখা যায়নি।
সূত্রমতে, সারা দেশে রেলওয়ের জমি রয়েছে ৬১ হাজার ৮৬০ দশমিক ২৮ একর। এর মধ্যে রেলের অপারেশন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ৩০ হাজার ৭৬৮ দশমিক ৫১ একর জমি। এ ছাড়া লাইসেন্স করা ও লিজ নেওয়া জমি রয়েছে ১৩ হাজার ২৩ একর। দখল অব্যবহৃত জমির পরিমাণ ১২ হাজার ৫৪৩ একর। রেলের জমি একেবারেই বেদখল হয়ে গেছে ৫ হাজার একরের মতো। রেলের দখলে অব্যবহৃত জমি রয়েছে মাত্র ১৩ হাজার ১০৭ একর। এর মধ্যে কৃষিজমি ১০ হাজার ৭১৬ দশমিক ৮১ একর।
রেলওয়ের সূত্রমতে, নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেললাইনের দুই পাশের প্রায় ২শ একর জমি দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এ পথে ছোট-বড় বাজার ও দোকানের সংখ্যা প্রায় হাজারখানিক। কোথাও জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে আবাসন কোম্পানির ভবনও তোলা হয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় ১৯ একর এবং নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে ২৯ একর জমি দখল হয়ে গেছে।
ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামে রেলের ২১৫ থেকে ২৩০ একর জায়গা দখল হয়ে আছে। এর মধ্যে অবশ্য ১৫০ একরই বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে। আর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে ৭৩ একর জমি। পাকশীতে দখল করা জমির মধ্যে ২ হাজার ৫৮ একরই বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলে। লালমনিরহাটে রেলের ৮৪১ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে আছে।
একইভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের দুই পাশের অনেক জায়গা দখল হয়ে গেছে। সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানেও একই অবস্থা। কোথাও মার্কেট আবার কোথাও বাড়ি-ঘর ও বস্তি বানিয়ে এসব জায়গা দখল করা হয়েছে। এদিকে লাখো কোটি টাকার এসব জমি উদ্ধারে রেল যেমন ব্যর্থ হচ্ছে তেমিন বছরে হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
রেল কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা যায়, জায়গা উদ্ধার কিংবা জমি সংক্রান্ত কাজে ব্যবহারের জন্য তাদের নিজস্ব কোনো সরঞ্জাম নেই। যে কোনো ছোট কিংবা বড় অভিযান পরিচলনার জন্য ভাড়া করে বুলডোজার এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম আনতে হয়। একেকটি বুলডোজার (ছোট-বড় সাইজ) ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। তাছাড়া শ্রমিকদের জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা করে দিতে হয়। এ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। ৩০ জন শ্রমিকের জায়গায় দেখানো হয় ৫০-৬০ জন শ্রমিক। একটি বুলডোজারের জায়গায় দেখানো হয় ২-৩টি বুলডোজার।
এ বিষয়ে রেল সংশ্লিষ্টরা ব্যর্থতা স্বীকার করে বলছেন, বেদখল জায়গা উদ্ধার করা যাচ্ছে না। যতটুকু উদ্ধার করা যাচ্ছে তাও ধরে রাখা যাচ্ছে না। বেদখল হওয়া জায়গা উদ্ধারের অভিযান পরিচালনা হয়ে আসছে কিন্তু উদ্ধার হওয়া জমিতে কোনো স্থাপনা কিংবা বেড়া না দিতে পারায় তা আবার বেদখল হয়ে যাচ্ছে।
সূত্রমতে, গত ২ মে সাত বছরের জেল-জরিমানার বিধান রেখে ‘রেলওয়ে সম্পত্তি (অবৈধ দখল উদ্ধার) আইন ২০১৬-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। কর্তৃপক্ষ বলছে, আইন কঠিন হয়েছে, এবার আমরা কঠোর হব। বেদখলে থাকা জমি উদ্ধারের পাশাপাশি যারা দখল করে রেখেছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।