ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বিচারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতার বৈশ্বিক সূচকে টানা দ্বিতীয় বছরের মত বাংলাদেশের অবস্থানের অবনমন ঘটেছে। ফোরামের ‘গ্লোবাল কমপেটিটিভনেস রিপোর্ট ২০১৯ বলছে, এবার ১৪১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে ১০৫তম অবস্থানে। আগের বছর ১৪০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১০৩তম অবস্থানে ছিল। অর্থাৎ ২০১৮ সালের চেয়ে চলতি বছর বাংলাদেশে দুই ধাপ পিছিয়ে গেছে। তার আগে ২০১৭ সালে ১৩৫ দেশের মধ্যে ছিল ১০২তম অবস্থানে।
সূচকে একটি দেশের অবস্থান বিচারের জন্য প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্য, দক্ষতা, পণ্য বাজার, শ্রম বাজার, আর্থিক ব্যবস্থা, বাজারের আকার, বাজারের গতিশীলতা, উদ্ভাবনী সক্ষমতা- এই ১২টি মানদ- ব্যবহার করেছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম। এসব মানদ-ের ভিত্তিতে ১০০ ভিত্তিক সূচকে সব মিলিয়ে এবার বাংলাদেশের স্কোর হয়েছে ৫২, যা গতবছরের স্কোরের চেয়ে শূন্য দশমিক এক কম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম বলছে, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা সূচকের ১২টির মধ্যে ১০টি সূচকেই পিছিয়েছে বাংলাদেশ। আর এগিয়েছে মাত্র দুটি সূচকে। যেসব সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়েছে সেগুলো হলো সামষ্টিক অর্থনীতি, শ্রমবাজার, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অবকাঠামো, পণ্য বাজার, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যবসায় বৈচিত্র্য, উদ্ভাবন এবং বাজারের আকার। অন্যদিকে এগিয়েছে দক্ষতা ও স্বাস্থ্যসূচকে।
বাংলাদেশে চলমান উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের এই প্রতিবেদন বৈপরীত্য প্রকাশ করে। সরকারের যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টা, দেখা গেছে সে জায়গাতেই অবনতি ঘটেছে। দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে, তার অর্ধেক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। দেশের নিজস্ব স্যাটেলাইটের ব্যবহার শুরু হয়েছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে অসংখ্য তরুণ কাজ করছে। তারপরও ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম বলছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশের স্কোর কমেছে। তাহলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের ঘাটতিটা কোথায়?
অবকাঠামোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে। সারাদেশে অবকাঠামোগত উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞ লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার সুফল কি বাংলাদেশ পাচ্ছে না? শ্রমবাজারের বিষয়টি নিয়ে দ্বিমতের জোরালো কারণ নেই, কেননা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজার ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে তা আমরা গণমাধ্যমে আগেই জেনেছি। ব্যবসায় বৈচিত্র ও বাজারের আকার নিয়ে আগের থেকেই সমস্যা ছিল যার অগ্রগতি হয়নি, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম সেটিই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে দেশের ব্যাংক ও শেয়ার বাজারে লক্ষ্য করলেই দুরবস্থা বোঝা যায়। আর উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের পিছিয়ে থাকা নতুন কিছু নয়। বিশ^বিদ্যালয়সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে গবেষণা নেই বললেই চলে, থাকলেও সেগুলো দিয়ে কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না।
সামষ্টিক অর্থনীতি, বাজারের আকার ও বাজারের গতিশীলতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতি করতে না পারার কারণ হলো, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি। সরকারি ঠিকাদারি কাজ পেতে ঘুষ, আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালনায় ঘুষ, কর দিতে ঘুষ -সবজায়গায় এমন ঘুষের কারবার চলতে থাকলে অবস্থা যে শোচনীয় হবে তা বলাই বাহুল্য। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য একটি বিশেষ গোষ্ঠীর হাতে থাকলে তা একচেটিয়া হয়ে ওঠে এবং তা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হয় না। একক ব্যবসায়ীর হাতে ব্যবসা খাত থাকলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ওই ব্যবসা খাতে আসতে পারেন না। ভোক্তাকে বেশি দাম দিয়ে ওই পণ্য বা সেবা কিনতে হয়।
আমরা চাই বাংলাদেশ যে যে খাত গুলোতে পিছিয়ে রয়েছে সেগুলোতে কর্তৃপক্ষ আরও মনযোগ দিক। ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত হয়েছে। এখন এসবের পিছিয়ে থাকার জন্য যে কারণগুলো রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। বৈশি^ক ক্ষেত্রে যদি এগিয়ে যেতে না পারে তাহলে শুধু স্থানীয় ক্ষেত্রে উন্নয়ন দেখালে তা দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনবে না।