ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে নিয়ে ফেসবুকে বিকৃত স্ট্যাটাস দেয়ায় বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে ধিক্কার জানিয়েছেন তার ভক্তরা।
ভারতকে পানি, গ্যাস ও সমুদ্রবন্দর দেয়ার বিরোধিতা করে গত ৫ অক্টোবর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন আবরার ফাহাদ। এর জেরে ৬ অক্টোবর রোববার রাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে লাশ সিঁড়িতে ফেলে রাখেন।
এ ঘটনায় আবরার ফাহাদকে নিয়ে নিজের ফেসবুক ওয়ালে বৃহস্পতিবার একটি বিতর্কিত স্ট্যাটাস দেন বাংলাদেশের নির্বাসিত এ লেখিকা।
তসলিমা নাসরিনের এ স্ট্যাটাসে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় বইছে। শুধু তাই নয়, লেখকের ফেসবুক বন্ধুরাও তার এই বিকৃত স্ট্যাটাসের সমালোচনা করে তাকে ধিক্কার জানাচ্ছেন।
বিজ্ঞাপন নির্মাতা আশরাফুল আলম সুমন ওরফে আনন্দ কুটুম লিখেছেন- ‘আমি মাঝে মাঝে হতভম্ব হয়ে যাই আপনার ফেসবুকীয় লেখা পড়ে। এই তসলিমা কি সেই তসলিমা, যার বই পড়ে যুক্তি শিখেছিলাম? আমি মাঝেমধ্যে খুব অবাক হই আপনার লেখা পড়ে যে, এতটা অন্ধত্ব আপনাকে কীভাবে গ্রাস করল?
তিনি বলেন, শুধু মুসলিমদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আপনি তাবৎ কাশ্মীরিদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে বিজেপির হাতকে শক্তিশালী করেন। আবরার স্রেফ মুসলিম বলে আপনার রায় চলে যায় খুনিদের পক্ষে।
‘‘ক্ষুরধার লেখক তসলিমা যখন মিনমিন করে খুনিদের পক্ষে লেখে- ‘মেরে ফেলার মোটিভ নিয়ে তারা মারেনি। হয়তো মাথায় আঘাত লেগেছে আর মরে গেছে’ তখন পক্ষান্তরে হত্যার অপরাধকে হালকা করা হয়।’’
আনন্দ কুটুম আরও বলেন, একজন মানুষ ব্যক্তিগতভাবে ধর্ম পালন করাতে তো কোনো অপরাধ নয়। আমাদের অভিযোগ সবসময় ধর্মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে।
‘আপনি ইদানীং অনেক ভুলভাল বলেন। এটাই স্বাভাবিক। বয়স বেড়েছে আপনার। একজন বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে আপনি নিশ্চয় জানেন যে, প্রতিটি হিউম্যান ব্রেনের কার্যক্ষমতা একদিন শেষ হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাচেতনাগুলো স্ট্রাকচারাল হয়ে যায়, অধিকতর দুর্বল আর সেকেলে হয়ে যায়। আপনার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে না।’
তসলিমার উদ্দেশে তিনি আরও লেখেন- আপনার বয়স বেড়েছে। মস্তিষ্কের বয়স বেড়েছে। সুতরাং তরুণ তসলিমার যে ক্ষুরধার চিন্তাচেতনা ছিল, তা বৃদ্ধ তসলিমার থাকবে না- এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তরুণ তসলিমার যা অর্জন তা এই বৃদ্ধ তসলিমা নষ্ট করে দিচ্ছে।
আবরার ফাহাদ হত্যা নিয়ে স্টেটমেন্ট দেয়া থেকে তসলিমাকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে আনন্দ কুটুম বলেন, স্টেটমেন্ট দেয়ার মতো স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি আর নেই। সব কিছুই একদিন শেষ হয়। এটুকু মেনে নিয়ে নতুন পৃথিবীর সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে চেষ্টা করুন। আপনার জন্য শুভকামনা। কথাগুলো এভাবে বলতে চাইনি। আপনার মানসিক অবস্থা, আপনার একাকিত্ব, আপনার যন্ত্রণাগুলো বুঝতে পারি। সব কিছুর বিচারেই তাই আপনার কথাগুলোকে জাস্টিফাই করি। তার পরও আজ বলে ফেললাম কথাগুলো।
জবাবে তসলিমা বলেছেন, বাহ্ বাহ্ বিরাট লাইক জুটেছে তোমার! এত লাইক তো নিশ্চয়ই তোমার পোস্টে সহসা মেলে না। বিশাল সাক্সেস, কী বল? মোল্লারাও জানত, তসলিমাকে গালি দিলে নির্ঘাত তালি পাবে। সরকারও জানে, তসলিমার বই ব্যান করলে বা গোটা তসলিমাকে ব্যান করলে বাকস্বাধীনতা নিয়ে লাফানো আঁতেলগুলো টুঁ শব্দ করবে না। আমার অল্প বয়সের লেখা পড়ে যুক্তি শিখেছিলে, ওখানেই থাকো। পরিণত বয়সের লেখা তোমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। যদি না বোঝো লেখা, না ভালো লাগে আমার লেখা, ব্যস পড়বে না- মিটে গেল। গালিবাজ মোল্লাদের মতো আমাকে বৃদ্ধ বলে অপমান করে তোমার স্থুল চরিত্রই প্রকাশ করলে, লাইক ছাড়া লাভ কী কিছু হলো? আমার বন্ধু তালিকা থেকে নিজে থেকেই বিদেয় হওয়া তোমার জন্য মঙ্গল- কী বলো?
তসলিমা এই মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় আনন্দ কুটুম লিখেছেন, আপনাকে আমি আবারও বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করছি- আমার কমেন্টস এবং আপনার কমেন্টস দুটো মনোযোগ দিয়ে পড়তে। আপনার কি সত্যিই মনে হয় যে আমার কমেন্টসের জবাবে এই কমেন্টস করা যায়?
‘মিজ তসলিমা, লাইকটাইক আমাদের মতো ছাপোষা পাঠকদের দরকার হয় না। ওগুলো মূলত লেখকদের দরকার হয় আলোচনায় আসতে, বেস্ট সেলের হতে, মিডিয়ায় টিকে থাকতে। আমরা স্রেফ মামুলি পাঠক, পড়েই খ্যান্ত। মাঝেমধ্যে একটুআধটু অভিমত জানাই মাত্র।’
তিনি বলেন, আমি কখনই আমাকে আপনার বন্ধু বলে দাবি করিনি। স্রেফ একজন শুভাকাঙ্ক্ষী বা ভক্ত হিসেবেই ভেবেছি। আপনি না চাইলে আপনার লিস্টে থাকার কোনো কারণ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো- আমি আপনার ফেবু লিস্ট থেকে বিদায় হলেই কি আপনার উপরোক্ত বক্তব্য সহি হয়ে যায় বা যাবে? আবার ভেবে দেখুন।
আনন্দ কুটুম আরও লেখেন- আপনি এতদিন আমার ফ্রেন্ড লিস্টে আছেন। অথচ আপনি কখনও লক্ষ্যই করেননি যে লাইকটাইকের ধান্ধায় আমি চলি না। আপনি কখনও লক্ষ্যই করেননি যে আপনার জন্য, আপনার নিরাপদ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য কয়েকশ লেখা আমি লিখে ফেলেছি। আপনি কখন লক্ষ্যই করেননি যে, আপনার জন্য কতবার কতজনের সঙ্গে ফাইট করেছি। এতটা অন্ধ আপনি কেমনে হলেন তসলিমা? এতটা সার্ফেস লেভেলে আপনি কেমনে চিন্তা করেন, সত্যিই আমার মাথায় ঢুকছে না যে আপনার একটি লেখার বিরোধিতা করার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও মোল্লাদের মতো, মৌলবাদীদের মতো ফুঁসে উঠে বলছেন বেরিয়ে যাও।
তসলিমাকে উদ্দেশ্য করে তিনি আরও বলেন, আপনাকে বৃদ্ধ বলাতে আমার অপরাধ হলে হোক। তা নিয়ে আমি লজ্জিত নই। আপনার কাছেই শিখেছি, সত্যকে সত্য করে বলতে। আপনি বৃদ্ধই। বৃদ্ধ আপনার বর্তমান চিন্তা ও বৃদ্ধ আপনার এই লেখাও। বৃদ্ধ কোনো গালি নয়। বৃদ্ধ হল বয়সের একটি নির্দিষ্ট স্টেজ। আপনি ইতিমধ্যে সেই স্টেজে পৌঁছে গেছেন।
‘আপনার বৃদ্ধ বয়সের লেখা বুঝতে পারছি না, এ জন্য সত্যিই আমার নিজের জন্য করুণা হচ্ছে। এবং তার থেকেও বেশি করুণা হচ্ছে এটি ভেবে যে, এই তসলিমার জন্যই কি তসলিমার পক্ষ নিয়েছিলাম? এই তসলিমার জন্যই কি গলা ফাটিয়েছিলাম? এই তসলিমার জন্যই কি এখনও লিখি? আফসোস!!’
রাহাত মুস্তাফিজ নামের একজন লিখেছেন- আপনার (তসলিমা) এই পোস্টটি সম্ভবত আমার পড়া সবচেয়ে বাজে পোস্ট। এই পোস্টের সমালোচনার জন্য অবশ্যই আমি লিখব।’
মনিরুজ্জামান খান লিখেছেন- ‘ধিক, আপনাকে আপনার এই পোস্ট ও ধার্মিকের স্বাধীনতা ও ধার্মিকতা বিনষ্ট করতে চাওয়ার জন্য। আল্লাহ আপনার সব অপচেষ্টা বিফল করে দেবেন।’
তিনি বলেন, ‘এই পোস্টে আপনি পক্ষান্তরে খুনি ও সংশ্লিষ্ট অন্যায়কারীদের সাফাই গাইলেন এবং শহীদের মর্যাদাকে ধর্মবিদ্বেষ প্রসূত নস্যাৎ করতে চাইলেন। এও তো সত্য যে, এমনকি ধর্মের লেবাস নিয়েও যদি কেউ অন্যায় করে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না।’
ফারাহ আশরাফ লিখেছেন- ‘ম্যাডাম, মেরে ফেলার বাসনা নিয়েই ছয় ঘণ্টা ধরে দফায় দফায় পেটানো হয়েছে তাকে (আবরার)। তারও আগে গণপিটুনি দেয়ার ইচ্ছা ছিল। সো, প্লিজ এইটা বলবেন না যে, মারার ইচ্ছা হয়তো ছিল না!’
মালয় তিওয়ারি নামের এক ভারতীয় নাগরিক লিখেছেন- ‘আপনার চিন্তাপদ্ধতিও আর আধুনিক বা বৈজ্ঞানিক মনে হয় না, মানবিক তো নয়ই।’
তিনি আরও লেখেন- ‘ভারতে হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে খুশি করতে গিয়ে লেখেন। তবে সেটা হয়তো টিকে থাকার বাধ্যবাধকতা।’
চাণক্য বাড়ৈ নামে একজন লিখেছেন- একজন বিজ্ঞানী সবসময় বিজ্ঞানমনস্ক না-ও হতে পারে। বিজ্ঞানমনস্কতা ভিন্ন ব্যাপার। তবে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রশ্নে এসব বিবেচ্য হতে পারে না।’
সুকান্ত চ্যাটার্জি নামের আরেক ভারতীয় নাগরিক লিখেছেন- ‘বাংলাদেশে নিউটনের তৃতীয় সূত্রের মতো কি ইসলাম বিরুদ্ধ কোনো শক্তি কাজ করছে?’ তাসলিমা মিজি নামে এক নারী লিখেছেন- ‘আপা, আমি বিস্মিত আপনার এই পোস্ট পড়ে। আপনি কাকে খুশি করতে এই লেখা লিখেছেন? যাকে খুশি করতে লিখেছেন, সে কিন্তু আপনাকে দেশে নিয়ে আসবে না।’
ভারতের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফাউন্ডামেন্টাল রিসার্চ কর্মকর্তা পাপ্পু লিখেছেন- ‘আপনি আর নেই দিদি, আপনি আর নেই, আমরা বৃথাই খুঁজি।’
ফাহাদ রহমান লিখেছেন- ‘আপনি এমনিতেই যথেষ্ট ফেমাস, নতুন করে আলোচনায় আসার জন্য এই রকম অবিবেচকের মতো উল্টাপাল্টা পোস্ট দেয়া বন্ধ করুন।’
আহমেদ জারিফ লিখেছেন- ‘আপনি ধর্ম বিশ্বাস করেন না, এটি তো জানাই আগে থেকে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সিলেক্টিভিটি নিয়ে। আপনার আগের লেখায় পূজামণ্ডপের গুণগান, আর এইখানে নামাজ হয়ে গেল অন্ধত্ব? সিলেক্টিভলি ইসলাম বিদ্বেষ হয়ে গেল না?’
একটা ছেলে মারা গেছে, স্রেফ একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য, পয়েন্ট ফোকাস সবসময় এখানেই থাকা এই জায়গায় নামাজ ধর্ম এগুলো আনার যুক্তি কি? আপনার এইখানে লেখার যেই পয়েন্ট তুলে ধরেছেন, এইগুলা যুক্তি না গার্বেজ। ‘যুক্তি’ নাম দিলেও এখান থেকে দুর্গন্ধ আসছে। আশা করছি আপনার মুক্তবুদ্ধির জড়ত্ব অচিরেই কেটে যাবে, ক্ষুরধার লেখনী ফেরত আসবে।’
সুরকার প্রিন্স মাহমুদ লিখেছেন- ‘‘এই ধরনের কথা আপনি লিখতে পারেন না। মাথা ঠিক আছে? কিছু কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি না, কিন্তু ‘তাকে যারা পিটিয়েছিল, আমার বিশ্বাস, মেরে ফেলার উদ্দেশে পেটায়নি। কিন্তু মাথায় আঘাত লেগেছে, মরে গেছে’। এত সহজে বলে ফেললেন! আপনি না মানবতার ধ্বজাধারী!!’’
তিনি বলেন, ‘আমার কথায় আপনার খুব রাগ হবে, আসল সত্য হলো একা একা থাকতে থাকতে আর ফেসবুকে ‘সহমত ভাইবোন’দের কল্যাণে আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। আপনার আসলেই চিকিৎসা দরকার। চাইছি, আপনি আমার ওপরে আরও বেশি রাগ হন, কিন্তু চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ থাকুন। প্রকৃতি আপনার সহায় হোক ..’