আবহমান বাংলার ঐতিহ্যের নৌকা বাইচ উপভোগ করার জন্য জেলার উজিরপুর উপজেলার হারতা ইউনিয়নের সন্ধার শাখা কচা নদীর দুই তীরে রোববার বিকেলে লাখো মানুষের ঢল নেমেছিলো। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও নৌকা বাইচ উপলক্ষে সন্ধ্যা নদীর শাখা কঁচা নদের তীরে মেলার আয়োজন করা হয়েছিলো।
লক্ষীপূজার দিন লক্ষী দসরা উপলক্ষে হিন্দু অধ্যুষিত হারতাবাসীর আয়োজনে রোববার বিকেল চারটায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় এবারও ফরিদপুর, মাদারীপুর, টেকেরহাট, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ীসহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নৌকা নিয়ে আসা আটটি পুরুষ ও দুইটি নারী দল অংশগ্রহণ করে। নদীর প্রশস্ততা ও জনসমাগমের কথা বিবেচনা করে আয়োজকরা দুই ভাগে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু করেন।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে ১৮৫৯ সালে লক্ষীপূজাকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মোড়লদের হাত ধরে এ নৌকা বাইচের যাত্রা শুরু হয়। এ প্রতিযোগিতা লক্ষীপূজাকে কেন্দ্র করে হলেও এটি এখন উজিরপুরবাসীর সার্বজনীন বিনোদন উৎসবে পরিনত হয়েছে। রোববার দুপুর থেকে সন্ধ্যা নদীতে একটু পরপর ঢোল-কাঁসা আর বাদ্যের তালে তালে ছুটে চলছে একেকটি বাইচের নৌকা। গন্তব্য হারতা বাজারের ঐতিহ্যবাহী কচা নদীতে বরিশাল বিভাগের সর্ববৃহৎ নৌকাবাইচে অংশগ্রহণ।
প্রতিবছর এখানে আয়োজন করা হয় বর্ণিল নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। বছর ঘুরতেই বাহারি রঙের নৌকা নিয়ে হাজির হয় মাঝিরা। দুপুর গড়াতেই কচা নদীর চলন্ত জলরাশিতে ছন্দময় একরাশ নৌকাবাইচ দেখতে ভিড় করেন লক্ষাধিক মানুষ। কাঁসা আর বাদ্যের তালে তালে মেতে ওঠেন নদীর পাড়ে অপেক্ষমাণ লক্ষাধিক দর্শক। নবনির্মিত হারতা ব্রিজ ও বাজারের আশপাশের প্রায় দুই কিলোমিটার জায়গাজুড়ে আয়োজন করা হয় ঐতিহ্যের নৌকা বাইচ। এ বছর নৌকা বাইচের ১৬০তম আসর অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বিকেল চারটায় শুরু হয় নৌকাবাইচের মূলপর্ব, নারী-পুরুষ মিলিয়ে মোট ১০টি বাইচের নৌকা এতে অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি নৌকায় ৩০/৪০ জন মাঝির অবস্থান। নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ আর নদীর পাড়ের লক্ষাধিক মানুষের মুহুর্মুহু করতালিতে কেঁপে ওঠে কচা নদী। মাইনুল ইসলাম মাঝি (৬৫), যিনি ছোটবেলা থেকেই এ বাইচ দেখে আসছেন। বলছিলেন-এলাকার মানুষ এ দিনটির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। আর হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে এ বাইচের আনন্দ উপভোগ করে।
আনন্দ-উচ্ছাসের মধ্যদিয়ে কঁচা নদীর চেয়ারম্যানবাড়ির ঘাট থেকে হারতা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় তিন বার নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। আশপাশের বাড়ি-দোকানের ছাদে এমনকি গাছে উঠেও উৎসুক মানুষ এই নৌকাবাইচ উপভোগ করেন। বিলাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে লক্ষী পূজার দিন আনন্দ দিতে ঐতিহ্যের এ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার প্রচলণ ধরে রেখেছেন হারতা বাজার কমিটি ও ইউনিয়ন পরিষদ।
গৌরনদী থেকে আসা দর্শনার্থী কাসেম আকন বলেন, নৌকা বাইচ উপলক্ষে হারতায় দিনব্যাপী মেলা বসেছে। মেলা দর্শনার্থীদের মাঝে যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা। তাই রোববার দিনভর হারতা এলাকাছিলো উৎসবের জনপদ। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান ইকবাল জানান, নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে বিভিন্নস্থান থেকে নৌ-পথে শতশত ট্রলার, লঞ্চ ও সড়ক পথে হাজার হাজার দর্শনার্থীরা ভিড় করেন হারতা বাজারে। দর্শনার্থীদের পথচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে নদীর দুই প্রান্ত। ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ উজিরপুরের সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে সেতু বন্ধন তৈরি করেছে।
নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান হরেন রায়ের সভাপতিত্বে প্রধানঅতিথি ছিলেন বরিশাল-২ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ শাহে আলম। বিশেষ অতিথি ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম জামাল হোসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হাফিজুর রহমান ইকবাল, বানারীপাড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ গোলাম ফারুক, উজিরপুর মডেল থানার ওসি শিশির কুমার পাল।
এবারের নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় দুইটি মহিলা দলসহ মোট ১০টি দল অংশগ্রহণ করেন। প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেছেন প্রসান্ত ওঝার দল, দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছেন কমলেস দাসের দল ও তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছেন মহানন্দ ও তার দল। বরিশালের জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান জানান, প্রযুক্তির ছোঁয়া আর সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে গ্রামের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তাই আবহমান বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্য নৌকা বাইচ টিকিয়ে রাখতে সরধরনের সহায়তা দেওয়া হবে বলে।