দেশজুড়ে গণপরিবহনে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে বিশেষ তদারকির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে পরিবহন খাতে অসাধুদের শাস্তি দিতে একটি রোডম্যাপ করা হয়েছে। চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা করলে, পরিবহনে অতিরিক্ত বা দাঁড়িয়ে যাত্রী নেয়া, নির্ধারিত স্থান ছাড়া যাত্রী ওঠানো বা নামানোর মাধ্যমে যাত্রী হয়রানি করা, নারী যাত্রীদের আসন সেবা সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিত না করা, সিটিং সার্ভিসের নামে বেশি ভাড়া নিয়ে উপযুক্ত যাত্রীসেবা না দেয়া এবং সিটিং সার্ভিসে একজন যাত্রী নির্ধারিত স্থানে নেমে গেলে তার সিট নতুন করে অন্য যাত্রীর কাছে বিক্রি করলে ভোক্তা আইনে শাস্তি দেয়া হবে। তাছাড়া শুধু স্পটেই নয়, যাত্রীরা কোনো ধরনের অনিয়ম পেলেই প্রমাণসহ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে এসে মামলা করতে যাবে।
পরে শুনানির মাধ্যমে অভিযোগের প্রমাণ মিললে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গণপরিবহনে ভাড়া নৈরাজ্য রোধ ও যাত্রীসেবা নিশ্চিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বিশেষ তদারকি সেল মাঠে নামছে। ওই লক্ষ্যে অধিদফতরের ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধানদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির নির্দেশে সারাদেশের বাসস্ট্যান্ডে বিশেষভাবে তদারকি করা হবে।
ওই সময় কোনো অনিয়ম পেলেই পরিবহন মালিক, চালক ও হেলপারসহ সংশ্লিষ্টদের ভোক্তা আইনের আওতায় শাস্তি দেয়া হবে। পরিবহন সেক্টর বর্তমানে ত্রাসে পরিণত হয়েছে। যার কাছে যেভাবে পারছে ভাড়া আদায় করছে। কিন্তু নির্ধারিত যাত্রীসেবা দেয়া হচ্ছে না। সরকারের দেয়া ভাড়ার মূল্যতালিকাও মানা হচ্ছে না। অনেক সময়ই পরিবহন সংশ্লিষ্টরা যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করে। সব মিলিয়ে একজন ভোক্তা পরিবহন খাতে সেবা নিতে গিয়ে অনেকভাবে প্রতারিত হচ্ছে। সেজন্যই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের ঢাকাসহ দেশের প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধানকে নিয়ে গঠিত কমিটির নেতৃত্বে বিশেষ তদারকি করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, রাজধানী ও আশপাশের রুটে চলাচলকারী বাসে সিটিং সার্ভিসের নামে লাগামহীনভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ওসব বাস লোকাল স্টাইলে চললেও আদায় করা হচ্ছে সিটিংয়ের নামে গলাকাটা ভাড়া। তাছাড়া একই রুটে বিভিন্ন পরিবহন ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া আদায় করছে। সরকার নির্ধারিত বড় বাসে ৭ টাকা ও মিনিবাসে ৫ টাকার সর্বন্মি ভাড়া কোনো গণপরিবহনই নেয় না। বরং সর্বন্মি ভাড়া ১০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে।
সূত্র আরো জানায়, বিগত ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। সরকার ওই সময় বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা ও মিনিবাসের ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করে দেয়। আর বাসের ৭ টাকা ও মিনিবাসের সর্বনিম্ন ভাড়া ৫ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গণপরিবহনগুলো রাজধানীর ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ভাড়া আদায় করছে ১০ টাকা। কিন্তু বিআরটিএ’র হিসাব অনুযায়ী, ফার্মগেট থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ২ দশমিক ৪ কিলোমিটার দূরত্বের হিসাবে বাসের ভাড়া ৪ টাকা ও মিনিবাসের ভাড়া ৪ টাকারও কম হওয়ার কথা। তবে সর্বন্মি ভাড়া হিসেবে ওই দূরত্বে বাসে ৭ টাকা ও মিনিবাসে ৫ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু পরিবহনগুলো ১০ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। তাছাড়া মহাখালী থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৮ টাকা। কিন্তু ওই রুটে বিভিন্ন পরিবহন ভাড়া আদায় করছে ২০ টাকা। একইভাবে রাজধানীর নর্দ্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার না হলেও তার জন্য বাস যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ২৫ টাকা।
এদিকে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মতে, বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়া নিতে গেলে পরিবহন শ্রমিকদের না খেয়ে থাকতে হবে। কারণ বিভিন্ন স্থানে টাকা দিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। মালিকরা সিটিং সার্ভিস চালুর মাধ্যমে অল্প কিছু টাকা বাড়িয়ে ভাড়া নির্ধারণ করেছে। যাতে যাত্রীদেরও কোনো সমস্যা না হয়। কিন্তু সব মিলিয়ে যদি সরকারের দেয়া চার্টে ভাড়া আদায় করা হয়, তাহলে লাভ তো দূরের কথা, চালানই উঠবে না। সেজন্যই মালিকপক্ষ ওয়েবিলের মাধ্যমে সিটিং সার্ভিস চালু করেছে। যার কারণে ভাড়া একটু বেশি।
অন্যদিকে বিআরটিএ সংশ্লিষ্টদের মতে, আইনে সিটিং সার্ভিস বা ওয়েবিল নামে ভাড়া আদায়ের কোনো বিধান নেই। ওসব কথা বলে বাড়তি ভাড়া আদায়েরও কোনো সুযোগ নেই। বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও প্রতি কিলোমিটার ১.৭০ টাকা এবং মিনিবাসে সর্বনিম্ন ৫ টাকা ও কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া ১.৬০ টাকা। এর বেশি ভাড়া নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সময় এমন অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেয়া হয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উদ্যোগ প্রসঙ্গে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের ( ক্যাব ) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের ( দুদক ) সাবেক চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান জানান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের এ পরিকল্পনা অনেক প্রশংসনীয়। আর এই তদারকি যদি জোরদার ও সুষ্ঠুভাবে করা যায়, তাহলে জনসাধারণের জীবনে স্বস্তি আসবে। কারণ টাকা খরচ করে ভোক্তার নির্ধারিত সেবা পাওয়া তার অধিকার। আর সেটা থেকে তাকে অনৈতিকভাবে বঞ্চিত করলে তার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। তাই এ বিষয়ে অধিদফতরের তদারকি করা উচিত। তবে তদারকি যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। বন্ধ হয়ে গেলে সাধারণ যাত্রীরা প্রতিকার পাবে না।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপ পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার জানান, গণপরিবহনের ভাড়া নৈরাজ্য ও যাত্রীসেবা নিশ্চিতে বিশেষ মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে। এর আগেও অধিদফতরের পক্ষ থেকে এমন কার্যক্রম চালু ছিল। ওই সময় প্রথম অবস্থায় রাজধানী ও পরে সারা দেশে তদারকি করা হয়। তবে এবার নতুন করে সেল গঠন করা হয়েছে। সেলের সদস্যরা কঠোরভাবে তদারকি করবেন। শিগগিরই এ সেল মাঠে নামবে। সপ্তাহের ৬ দিন রাজধানীসহ প্রত্যিকটি জেলার বাসস্ট্যান্ডে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করবে। কমিটির সদস্যরা অধিদফতরের পরিচয় না দিয়ে যাত্রী হিসেবে গণপরিবহনে ভ্রমণ করবেন। ওই সময় ভাড়া ও যাত্রীসেবা নিয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্টরা কোনো ধরনের নৈরাজ্য করলেই মালিক থেকে শুরু করে চালক ও পরিবহনের হেলপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ভোক্তা আইনে মামলা করে শাস্তির আওতায় আনা হবে। আর শাস্তির ক্ষেত্রে প্রাথমিক অনিয়মে জরিমানা ও বড় ধরনের অনিয়মে জেলে পাঠানো হবে।