কখনো আমার মাকে শিরোনামের কবিতায় কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, কখনো আমার মাকে কোনো গান গাইতে শুনিনি।/ সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/ আমাকে কখনো ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনেই পড়ে না।/ যখন শরীরে তার বসন্তের সম্ভার আসেনি,/ যখন ছিলেন তিনি ঝড়ে আম-কুড়িয়ে বেড়ানো/ বয়সের কাছাকাছি হয়তো তখনো কোনো গান/ লতিয়ে ওঠেনি মীড়ে মীড়ে দুপুরে সন্ধ্যায়/ পাছে গুরুজনদের কানে যায়। এবং স্বামীর/ সংসারে এসেও মা আমার সারাক্ষণ/ ছিলেন নিশ্চুপ বড়ো, বড়ো বেশি নেপথ্যচারিণী। যতদূর জানা আছে, টপ্পা কি খেয়াল তাঁকে করেনি দখল/ কোনোদিন। মাছ কোটা কিংবা হলুদ বাটার ফাঁকে/ অথবা বিকেলবেলা নিকিয়ে উঠোন/ ধুয়ে মুছে বাসন-কোসন/ সেলাইয়ের কলে ঝুঁকে, আলনায় ঝুলিয়ে কাপড়,/ ছেঁড়া শার্টে রিফু কর্মে মেতে/ আমাকে খেলার মাঠে পাঠিয়ে আদরে/ অবসরে চুল বাঁধবার ছলে কোনো গান গেয়েছেন কি না/ এতকাল কাছাকাছি আছি তবু জানতে পারিনি।/ যেন তিনি সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে/ রেখেছেন বন্ধ ক’রে আজীবন, এখন তাদের/ গ্রন্থিল শরীর থেকে কালেভদ্রে সুর নয়, শুধু/ ন্যাপথলিনের তীব্র ঘ্রাণ ভেসে আসে !
কবিতার কথাটি প্রায়ই পথ হাঁটতে হাঁটতে উচ্চারণ করে তানশা। তানশা তার মায়ের অপেক্ষায় থাকে সব সময়। ভাবে মা আসবে, আদর করবে, কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলবে-
তানশা তুমি তোমার চোখ বন্ধ করো, আমি লুকোই গিয়ে। কানামাছি খেলাটা দারুণ পছন্দ করে তানশা; তবে দেশ বিরোধী চক্রের পত্রিকা কানামাছি দু’চোখেও দেখতে চায় না সে। যেমন দেখতে চায়না বাবাকে। বাবাটার জন্যই আজ তার এত কষ্ট। তানশার বয়স তখন সাড়ে আট মাস। বাবা তানশাকে আর বড় ভাইয়াকে নিয়ে আসে নিজের কাছে। তারপর থেকে এক ভীষণ শূন্যতার মধ্যে আটকা পড়েছে সে। সেটা জীবনের নানা মোড়ে বারবার উপলব্ধি করতে হয়েছে। ট্রেনে নিয়ে আসার সময় তানশা যতটুকু ছিল, ততটুকুতে স্মৃতি রোমন্থন করা যায় না যদিও; তবুও তানশার প্রায়ই মনে হতো সেদিন মানুষের ভিড়ে একটু ভড়কে গিয়েছিলাম, বোধ হয় ভয়েই চিৎকার করে কেঁদেছিলাম। তারপর আরও কতবার আমি ভয় পেয়েছি, ওয়া ওয়া বলে ডেকেছি, কান্নায় বুক ভাসিয়েছি। কিন্তু আমার ভয় ভাঙিয়ে দিতে কেউ আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলেনি, এই তো মা আছে তোমার পাশে। বড় বড় হতে যখন ৬ অথবা সাত বছর বাবা তখন নতুন একজন মা নিয়ে এলেন বাড়িতে। আমি খুব খুশিই হয়েছিলাম। দিনমান নতুন মায়ের আশপাশে ঘুরে বেড়াতাম। আমার খুব ইচ্ছে করত ছুটে গিয়ে নতুন মাকে জাপটে ধরি, যেমন করে নমিমো ধরে তাঁর মাকে, নমিমোর মা তখন কপট রাগ দেখিয়ে বলেন, দুষ্টু একটা ছেলে। নতুন মা পেয়ে আমি ভাবতাম, কখন মা আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করবে। নতুন মা আমাকে কখনো কাছে ডাকল না। ধীরে ধীরে সংসারের সব কাজ আমার হাতে উঠতে লাগল। নতুন মাকে ভালো করে দেখার সুযোগ আমার মেলে না। তবু একটু ফুরসত পেলেই দৌড়ে গিয়ে নতুন মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতাম। আমি আশা নিয়ে শুধু দেখতাম। কোন দিন বিরক্ত করিনি। সবার মুখে শুনেছিলাম, তুমি চেয়েছিলে তোমার মেয়ে পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। আমি সেটা পারিনি। নতুন মা বাবাকে বলেছে, আমার আর স্কুলে যেতে হবে না। তাই আমি পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার পর আর স্কুলে যেতে পারিনি। মা, আমি একটুও মন খারাপ করিনি। আমি নতুন মাকে দেখি, ছোট ভাই-বোনদের বেড়ে ওঠা দেখি। সংসারের সব কাজ করি। তুমি কি আমাকে দেখতে পাও মা? তুমি কি জানো আমি ঘরকন্নার কাজে কত পটু হয়ে গেছি। বাড়িতে তোমার একটাও ছবি ছিল না। তাই তোমার মুখের আদল আমার কাছে অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়লেই দেখি আমার দিকে তুমি দুই হাত বাড়িয়ে রেখেছ কিন্তু তোমার মুখটা লম্বা ঘোমটায় ঢাকা। আমি তোমার মুখটা দেখতে পাই না। তোমার কাছে ছুটে যাওয়ার আগেই স্বপ্নটা ভেঙে যায়। তোমার কোলে আমার ছুটে যাওয়া হয় না। আমি কাঁদি, চিৎকার করে কাঁদি, আমার কান্নার শব্দ কি তুমি শুনতে পেয়েছিলে? আমার মনের ভেতরে মায়ের মমতা পাওয়ার হাহাকার। সবকিছুর মাঝেও তোমার কথা ভেবে বুকের ভেতর মুচড়ে ওঠে। এখনো স্বপ্নে তুমি একইভাবে দেখা দাও। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আমি সেই সাড়ে আট মাসের শিশু হয়ে যাই। গুঙিয়ে কাঁদতে থাকি তোমার জন্য। আমি তোমার কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় আছি। যখন যেতে পারব তুমি কি তোমার এ মেয়েটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরবে! আমার কপালে কি চুমু খাবে! মা, তোমার মুখের ওপর থেকে ঘোমটা একটু সরিয়ে নাও। আমি মন ভরে তোমাকে দেখতে চাই। তোমার স্নেহের পরশে আমার ভেতরের হাহাকার থেমে যাক। মা, আমার জন্য, আমার আলোকিত আগামীর জন্য তোমরা কি পারো না নিজেদের দূরত্ব ঘোচাতে? প্রশ্ন বোধক এই চিহ্নটা ঝুলে ছিল তানশার চোখে মুখে। ঠিক এসময় দেখা হয় নমিমোর সাথে। নমিমো তানশার ভালো বন্ধু। সময় সুযোগ হলে এক সাথে খেলে, গল্প করে। যদিও ছোট মা নমিমোকে দেখতেই পারে না; তাতে তানশার কিছু যায় আসে না। তানশার কাছে বরাবরই নমিমো ভালো বন্ধু, ভালো খেলার সাথী। তানশা যখন স্কুলে পড়তো তখন নমিমো ছিলো সেকেন্ড ক্যাপটেন। এখন যদিও নমিমোই ফার্স্ট ক্যাপটেন। কেননা, তানশা নেই। নমিমো প্রায়ই বলে-
তানশা আমি বড় হলে তোমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবো। পরে আবার বলে, ও না তাতো হবে না। কেননা, তখন তুমিও আমার মত বড় হয়ে যাবে। যাক দুঃখ করো না। আমি তোমার সাথে আছি। তানশার কাছে এই কথাটি শুনলেই বলতে ইচ্ছে করে-
তাই যেন থাকো। মা নেই। দূরত্ব তৈরি করে চলে গেছে বহুদূরে। তুমি আমার একমাত্র বন্ধু, তুমিও যদি চলে যাও; তাহলে আমি কাকে নিয়ে খেলবো, গল্প করবো কার সাথে? প্রশ্ন মানেই তানশার রঙিন আকাশে কালোমেঘের ঘনঘটা। তানশার কাছে কষ্টের সকল কালোমেঘ দূর করার একমাত্র রঙধনু ‘মা’। মায়ের রঙধনু থাকলে কষ্টের কালোমেঘ দূর করতে সময় প্রয়োজন ৫ সেকেন্ড...