বাংলাদেশের নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির মূল মন্ত্র হচ্ছে বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই। ভারত আমাদের প্রতিবেশী বড় রাষ্ট্র। এদেশের জনগণ কখনও ভারতসহ দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনাহুতভাবে অহেতুক নাক গলায় না। বরং মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ১ কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও সহযোগিতা করার জন্য আজও ভারত সরকার ও জনগণের সহযোগিতাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ ও মূল্যায়িত করে থাকে। তদোপরি তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়াসহ আরও অনেক দেশের সরকার ও জনগণের অবদানকে অস্বীকার করে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পূর্বাকাশে স্বাধীনতার প্রভাতী সূর্যের পর থেকে ভারত একটার পর একটা আগ্রাসী কান্ড বাহাদুরী, কৃষ্ণকর্ম ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে যাচ্ছে। যা প্রতিবেশী দেশ হিসেবে কোনো মতেই আমাদের কাম্য নহে। যে জ্বালা মনে মানে না, প্রাণে সহে না। যে দুঃখ বেদনা, অশ্রুধারা ও উদাহরণের শেষ নেই। যা আগেভাগে বুঝতে পেরেই হয়তো শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের জল্লাদদের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে প্রথমে লন্ডন তারপর ভারত এবং ৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পন করেছিলেন। লন্ডনে পদার্পন করে ড. কামাল হোসেনসহ আরও অনেকের কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসের সবকিছু জেনে নিয়েছিলেন।
৯৩ হাজার হানাদার বাহিনীর পরাজিত খুনী, জল্লাদ, নারী নির্যাতনকারী ও ১৯৫ জন চিহ্নিত জঘন্য অপরাধীকে ৭২ সালে ইন্দিরা ভুট্টোর সমঝোতা সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানে ফেরত দেয়া হয়ে থাকে। জানা যায়, সেই সময় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য কাহাকেও এ চুক্তিকালে রাখা হয়নি। এমনকি এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের মতামত নেয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি ভারতের শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সরকার। অবস্থা দেখে মনে হয়েছে যুদ্ধটা যেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে যেন কোনো যুদ্ধ হয়নি। তা না হলে কুলাঙ্গার, জল্লাদ, খুনী, নারী নির্যাতনকারী ৩০ লক্ষ লোককে হত্যাকারী ও জঘন্য মানবতা বিরোধী কষাই ও ডাল কুত্তাদেরকে এমনিভাবে ইন্দিরা ভূট্টোর সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানে ফেরত দেয়ার প্রশ্ন উঠতনা।
স্বাধীনতার পর ভারতীয় মিত্রবাহিনী ভারতে ফিরে যাওয়ার আগে ও ফিরে যাওয়ার সময় এদেশের মূল্যবান সম্পদ অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে থাকে। আদমজী, ঢাকেশ্বরী কটন মিল, কিশোরগঞ্জের ন্যাশনাল সুপার মিলের মূল্যবান পার্টস, জাপানি ট্রেটরন কাপড় ও পাকিস্তানের রেখা যাওয়া গুলাবারুদ পাচার করে থাকে। জানা যায়, সেই সময়
বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকার পাট নিয়ে যায়। ভারতের বন্ধ পাটকলগুলো চালু করে। ডান্ডিসহ সারা দুনিয়ায় একচেটিয়া পাটের বাজার সৃষ্টি করে থাকে। তখন এদেশ থেকে লুটেপুটে নেয়ার সময় বেলুনিয়া সীমান্তে ৯ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল তাতে বাধা প্রদান করে থাকে। এমনকি সিলেটের সুনামগঞ্জের টেঁকের হাট চুনাপাথর খনিতে (টিএলএম প্রজেক্ট) পাথর উত্তোলনের সময় অহরহ ভারতীয় বিএসএফরা ভয় ও আতংক সৃষ্টি করতে দ্বিধা সংকোচ করেনি। এসব কিছু বড় দেশ হিসেবে ভারতের নিকট বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল না। উজানের ৫৭টি নদীতে গ্রোয়েন নির্মাণ, ফারাক্কার বাঁধ দিয়ে আন্তঃনদী কমিশন হেলসিংকি নীতিমালা লংঘন, তিস্তার ন্যায্য পানি না দিয়ে দেশের উত্তর বঙ্গের কয়েকটি জেলাকে মরুভূমিতে পরিণত করায় ভারতের ন্যাক্কার জনক নীলনক্সাও অশোভনীয়। মানবতার কথা বলে, ত্রিপুরার জন্য ফেনী নদীর পানি চুক্তি করলেও এদেশের ১৭ কোটি মানুষের দুঃখ কষ্ট ও মানবতার কথা বিবেচনা করে তিস্তার ন্যায্য পানি না দিয়েও ৫৭টি নদীতে গ্রোয়েন সৃষ্টি করেছে। ইতোপূর্বে বিএসএফ ফেলানীকে নির্মমভাবে হত্যা করে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখে। দফায় দফায় আবেদন করলেও ফেলানীর মা বাবা আজও ফেলানী হত্যার বিচার পাচ্ছে না। এসব কিছু যেন লোক দেখানো ঢং ও বিচারের নামে ভারত প্রহসন করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি র্যাবের ৫ জন সদস্যকে সামান্য ভুল এবং ভুল স্বীকারের পরও বিএসএফ চরমভাবে অমানুষিক নির্যাতন করে থাকে। যা পরবর্তী সময় দুপক্ষের পতাকা মিটিংয়ের পর তাদেরকে ফেরত দেয়া হয়ে থাকে। এমনিভাবে বিএসএফদের পাশাপাশি ভারতীয় ঘোষ বাহিনী বলে খ্যাত এ শ্রেণীটা অহরহ বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে ফসলি ক্ষেতের শষ্যসহ গরু, বাছুর, ছাগলসহ নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। যে ব্যাথা, বেদনা ও দুঃখ বলার জায়গা যেন সীমান্তে বসবাসকারীদের সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। এসব কিছুই ভারতের বিএসএফ ও তাদের একটার পর একটা আগ্রাসী কান্ড। এসব কিছুই তাদের আগ্রাসী কান্ড, বাহাদুরী, কৃষ্ণকর্ম ও দাম্ভিকতাই অংশ বিশেষ।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ভারত সরকার ও বিএসএফের কর্মকান্ড ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ করলে তাদের কাছ থেকে জওয়াব বা সমাধানের আদ্যোপান্ত খুঁজে পাওয়া যেন বাস্তবতার কঠিন বিরহ ও নিলর্জ্জতার বিষাদের দলিল ও ভাওতাবাজির দিকদর্শন। এসব ব্যাপারে কিছু বললে বা লেখলে যদি কেহ মনে করে এদেশের জনগণ ভারত বিদ্বেষী, তবে তা আদৌ ঠিক নহে। আসলে এদেশের মানুষ ভারত বিদ্বেষী নয়। আসলে অনেক সময় অপারগ হয়ে তাদের আগ্রাসী কান্ড, কৃষ্ণকর্ম ও দাম্ভিকতাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। ঠাকুর ঘরে ঠাকুর কিভাবে কলা খেয়েও বারবার বলে থাকে, ঠাকুর ঘরে কেরে আমি কলা খাই না। এ নিবন্ধের প্রারম্ভেই বলা হয়েছে, ভারতের অবদানকে এদেশের সরকার ও জনগণ কখনও ভুলে যায়নি বা অস্বীকার করেনি। ভারতকে বন্ধু রাষ্ট্র বা সুপ্রতিবেশী দেশ হিসেবে মনে করে থকে। তবে ভারত এদেশকে কিভাবে গ্রহণ করে থাকে এটাই লক্ষ্য করার ব্যাপার।
গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, ১৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার রাজশাহীর চারঘাট সীমান্তে বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্ত রক্ষিবাহিনীর (বিএসএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় এক বিএসএফ সদস্য নিহত হয়েছে। জানা যায়, ঐ দিন সকালে বেআইনীভাবে পদ্মা নদীতে ভারতীয় জেলেদের ইলিশ শিকারকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে থাকে। তখন বিএসএফের কয়েকজন সদস্য রাজশাহীর চারঘাট সীমান্তের ৫০০ গজের মধ্যে এলে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আটকদের মধ্যে একজন বিএসএফ সদস্যও ছিল। পরে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাদেরকে হস্তান্তরের কথা জানালে তারা পলায়নের চেষ্টা করে এবং ওপেন ফায়ার করে। তাতে সীমান্ত রক্ষিবাহিনী (বিজিবি)ও ওপেন ফায়ার করে থাকে। এদিকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিজিবি জানায়, সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে রাজশাহীর চারঘাট সীমান্ত এলাকায় বিওপি এলাকায় আনুমানিক ৩৫০ গজ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পদ্মা নদীতে ৩ জন ভারতীয় জেলেকে ইঞ্জিন চালিত নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখা যায়। এ সময় বিজিবির টহলদল উপজেলার মৎস্য অধিদফতরের ফিল্ড এ্যাসিসট্যান্ট ও আরও দুইজন সহকারি নিয়ে ভারতীয় জেলেকে আটক করা হয়। বাকিরা পালিয়ে যায়। পরে বিএসএফের ১১৭ ব্যাটালিয়নের কাগমারি বিওপি থেকে স্পিডবোটে ৪ জন বিএসএফ সদস্য চারঘাট উপজেলার বালুঘাট এলাকার শাহরিয়া ঘাটের বড়াল নদীর ঘাটে আনুমানিক ৬৫০ গজ বাংলাদেশের ভেতরে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করে থাকে। বিজিবির টহল দল তাতে বাধা দেয়। ওই ৪ জনের মধ্যে ১ জন বিএসএফ ইউনিফর্ম পরা থাকলেও বাকিরা হাফপ্যান্ট ও গেঞ্জি পরা ছিল।
বিএসএফও জেলেকে জোর করে নিতে চাইলে তাদেরকে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে ফেরত নেয়ার কথা বলে বিজিবি। তাদের বলা হয়, আপনারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছেন। তাই আপনাদেরকেরও নিয়ম অনুযায়ী পাতাকা বৈঠকের ।
মাধ্যমে হস্তান্তর করা হবে। তখন বিএসএফ সদস্যরা জোর পূর্বক জেলেকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে চাইলে বিজিবি সদস্যরা তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিএসএফ সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে ফায়ার করতে করতে স্পিডবোট চালিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে চলে যেতে থাকে। তখন বিজিবি টহল দলও আত্মরক্ষার্থে ফায়ার করে। এ বিষয়ে রাজশাহী ব্যাটালিয়ন কমান্ড্যান্ট ও ১১৭ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের মধ্যে পাতাকা বৈঠকের কথা জানা যায়। এ ঘটনায় ১ জন বিএসএফ সদস্য নিহত ও অপর ১ জন আহতের কথা জানা যায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বার্লিন সফরে থাকা অবস্থায় ১৯/১০/১৯ ইং শনিবার স্থানীয় সময় সকাল ১১টায় ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তারাই (বিএসএফ) আমাদের এখানে এসেছে এবং এসে তারা বাহাদুরী করেছে। আমাদের ছেলেদের (বিজিবি) তাদের লাষ্ট জব হিসেবে বাধ্য হয়েই গুলি করতে হয়েছে। একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণেই হয়তো এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি আরও বলেছেন, বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে গোলাগুলি এবং বিএসএফ সদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন (যুগান্তর ২০/১০/১৯ ইং)।
জানা যায়, কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে জিরো লাইনের ভেতরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করেছে বিএসএফ। ২২/১০/১৯ ইং মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার খালিশা কোটাল সীমান্তে বেড়া নির্মাণ শুরু করেছে বিএসএফ। ভারতীয় কুশরিহাট দিন হাটা সড়কের আন্তর্জাতিক ৯৩৪ থেকে ৯৩৪/১১ এস পিলার পর্যন্ত জিরো লাইনে প্রায় ১ কিলোমিটার সড়ক ৭৫ বছর আগে নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময় তারা সড়কটি মেরামত করে। পরে সড়কটির দুধারে কাঁটাতারের পেঁছানো অবস্থায় ফেলে রেখে বিএসএফ। এ নিয়ে বারবার বিজিবি ও বিএসএফ পতাকা বৈঠকও হয়ে থাকে। কিন্তু মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বিএসএফ ৯৩৪ আন্তর্জাতিক পিলারের ৪ এস হতে ৫ এস পিলার পর্যন্ত শূন্য রেখায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে থাকে। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট ১৫ ব্যাটালিয়নের বলার হাট বিওপির বিজিবির সদস্যরা সীমান্তে কড়া নজর রাখছে বলে জানা যায়।
বিএসএফের একটার পর একটা আগ্রাসী কান্ড, বাহাদুরী, কৃষ্ণকর্ম ও দাম্ভিকতা কোনো অবস্থাতেই স্বাধীন সার্বভৌম এদেশের জনগণ ও সরকার মেনে নিতে পারে না। এমনকি কোনো আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদকেও এদেশের মানুষ মেনে নিতে পারে না। বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা আমাদের গর্ব ও অহংকার। এদেশকে কারও সিকিম, ভুটান ও নেপাল মনে করা ঠিক নহে। এদেশের লাল সবুজের পতাকার স্তরে স্তরে রয়েছে ত্যাগ ও তাজা রক্তের সমাহার। তাই হয়তো একজন কবি বলেছেন, মরণের পরপারে যেই বেশে, যেই দেশে যাই এদেশের আকাশ, বাতাস, আলো, নদ-নদীর কলতান, দোয়েল, কোকিল, পাপিয়ায় সুমধুর কণ্ঠ ও লাল সবুজের পতাকা যেন দেখিবারে পাই। সকল প্রকার আগ্রাসন ও আধিপত্য বাদ থেকে দেশকে রক্ষা করাই হোক আমাদের শপথ। সীমান্ত পাহাড়ায় নিয়োজিত বর্ডারগার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের নিরলস প্রচেষ্টা, ত্যাগ, দায়িত্ব ও প্রশংসনীয় কর্তব্যই জনপ্রত্যাশা। বিজিবি আমাদের গর্ব, অহংকার ও সীমান্ত রক্ষায় অতন্ত্র প্রহরী।
এ.কে.এম শামছুল হক রেনু
লেখক কলামিষ্ট