এক সময়ের ভারতের কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যে যাওয়ার ইমিগ্রেশন রুট ছিল লালমনিরহাটের মোগলহাট। ওই সময় এই রুটে ট্রেন চলাচল করতো। ইমিগ্রেশন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পরই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সেই লালমনিরহাট মোগলহাট রেলপথের ১২ কিলোমিটারের মধ্যে ১০ কিলোমিটার লাইন ও শ্লিপার চুরি করে নিয়ে গেছে চোর সিন্ডিকেটের মূল হোতা মিজান ও সঙ্গপাঙ্গরা। মামলা দিয়েও রক্ষা হয়নি ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকা এ রেলপথ। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় বাকি মাত্র ওই দুই কিলোমিটার রেল পথের লাইনও খোয়া যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
রেলভবন ও স্থানীয়রা জানায়, বৃটিশ আমলে উত্তর জনপদের লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের মাধ্যমে ভারতের কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যের সঙ্গে রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল। ভারতবর্ষের রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাণ কেন্দ্র ছিল লালমনিরহাট। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত বিভক্তির পরও লালমনিরহাট সদরের মোগলহাট হয়ে ভারতের সঙ্গে রেলওয়ে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
এই রেলপথের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার উৎপাদিত পাট, চা, তামাক, চামড়া, ধান, চাল ও শালকাঠ ভারতে যেত। ভারত থেকে কয়লা, লুবলেকেটিং ওয়েল, ডিজেলসহ অন্যান্য মালামাল আমদানি করা হতো। এছাড়াও দু’দশের পাসপোর্টধারী যাত্রীদের চলাচলে মোগলহাটে একটি চেকপোস্ট ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থা চালু ছিল। প্রতিদিন দু’দেশের শতাধিক পাসপোর্টধারী যাত্রী মোগলহাট হয়ে ও যাতায়াত করতো। সড়ক পথে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় আশির দশকে ১২ কিলোমিটার লালমনিরহাট-মোগলহাট রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর থেকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে লালমনিরহাটের এ রেলপথটি। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলায় দিন দিন নষ্ট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ। এরমধ্যে লালমনিরহাট মোগলহাট ১২ কিলোমিটার পথের প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকার লাইন ও স্লিপারসহ সব কিছু চুরি হয়ে যায়। তবে এ রেলপথ ও স্থলবন্দরটি পুনরায় চালু করতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন স্থানীয়রা। সম্প্রতি নেপালের একটি প্রতিনিধি দল রেলপথসহ স্থলবন্দরের সম্ভবতা যাচাই করতে পরিদর্শন করেন।
২০১২ সালে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) রেলওয়ের চুরি যাওয়া কিছু লাইন উদ্ধার করলে বাধ্য হয়ে রেলওয়ে থানায় লিখিত অভিযোগ করেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী প্রকৌশলী আবদুল লতীফ। তবে সেই অভিযোগে চোর বা চুরির পুরো তথ্য দেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে জিআরপি পুলিশ তদন্ত করে লালমনিরহাট শহরের সাপ্টানা এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে মিজানুর রহমান মিজান ও কুরুল এলাকার কোরবান আলীর ছেলে শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ মামলার প্রধান আসামি মিজানের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মাদক ও চোরাচালন মামলাও বিচারাধীন রয়েছে। মামলার পরেও রেল লাইন চুরি বন্ধ করেনি। বরং লালমনিরহাট রেল বিভাগের বেশির ভাগ এলাকার লাইন চুরির সাথে সম্পৃক্ত হয় মিজান ও তার সঙ্গপাঙ্গরা। এরপরও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় মিজান দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়রা জানান, রাতের আঁধারে মিজান ও তার সঙ্গপাঙ্গরা স্থানীয়দের জিম্মি করে রেললাইন কেটে নিয়ে যান। এর প্রতিবাদ করলে তাদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। আপাতত দুই কিলোমিটার অংশে ভুমিহীনরা ঘরবাড়ি নির্মাণ করে বসবাস করায় তা চুরি করতে পারেনি। তবে তাদের ঘর সরাতে হুমকি দিচ্ছে চক্রটি বলেও জানিয়েছেন তারা।
রেললাইন চুরি মামলার সাক্ষী কর্নপুর পাতুরগেট এলাকার মন্টু মিয়া বলেন, যখন লাইন চুরি যায় তখন আমি ঢাকায় রিকশা চালাই। আমি কিছুই জানি না তবুও পুলিশ আমাকে সাক্ষী করেছে। যারা দেখেছে তাদের সাক্ষী করা হয়নি। রেল লাইন চুরির সাক্ষীরা অনেকেই ঘটনার সময় কাজের সন্ধানে এলাকার বাইরে ছিলেন। ফলে প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর অভাবে মামলার জট খুলছে না।
মোগলহাট ইউনিয়নের কর্ণপুর পাতুরগেট গ্রামের আবুল হোসেন ও সিরাজুল ইসলাম বলেন, ৫/৭ বছর আগে দুর্বৃত্তরা রাতের আঁধারে রেললাইন কেটে নিয়ে যায়। বাকি অংশটুকুও কেটে নেওয়ার চেষ্টা করছে মিজান ও তার দলবল।
মোঘলহাট রেলওয়ে স্টেশন অফিসে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন নদী ভাঙনের শিকার ষাটর্ধ মরিয়ম বেওয়া। তিনি বলেন, নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে পরিত্যক্ত রেল অফিসে ২০/২৫ বছর ধরে থাকছি। রেলচালু হলে স্বেচ্ছায় চলে যাবো।
রেলওয়ে লালমনিরহাট বিভাগীয় ব্যবস্থাপক শফিকুর রহমান শফিক বলেন, পরিত্যক্ত এ রেলপথ পুনরায় চালু করে ভারতের গিতালদাহের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ রক্ষায় উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কয়েক দফায় পরিদর্শন করেছেন। তবে এখন না হলেও ভবিষ্যতে এই রুটে ভারতে যাওয়ার ইমিগ্রেশন চালু হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। রেললাইন চুরির বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে রেলওয়ের সম্পদ রক্ষায় অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।