ঝালকাঠি জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলোতে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন নিয়ে এসবি ট্রেডার্স নামে একটি কোম্পানীর বিরুদ্ধে কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এমনকি প্রধান শিক্ষকদের কোন অনুমতি না নিয়েই তারা বিদ্যালয়ে মেশিন বসিয়ে তিন গুণ দাম আদায় করছে। ঝালকাঠি সদর উপজেলায় তাদের এই বাণিজ্যে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছালেহা খাতুনের বিরুদ্ধে সহায়তার অভিযোগ করেছে শিক্ষকরা। এসব কারণে জেলার ৪ টির মধ্যে ৩ টি উপজেলায় ডিজিটাল মেশিন ক্রয়ের কার্যক্রম ইতিমধ্যেই স্থগিত হয়েছে। এসবি ট্রেডিং কোম্পানীর ২৯ হাজার ৫শ টাকার মেশিন বাজার দর ১০ হাজার টাকা। এ হিসাবে জেলার ৫৮৪ টি বিদ্যালয় থেকে বাড়তি ১ কোটি ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা চালাচ্ছে এসবি কোম্পানী। তাৎক্ষণিক ভাবে এই অর্থ দিতে না পারায় অনেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ব্যক্তিগত হিসাবের চেক দিতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ কোম্পানীর দাবী করা টাকা না দিলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কথা বলে এ টাকা আদায়ের অভিযোগ করেছে শিক্ষকরা। ঝালকাঠির সকল বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দাবি কোম্পানীসহ এই বাণিজ্যের সাথে যারাই জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত।
ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানাযায়, জেলায় মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৮৪ টি। এরমধ্যে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত সদর উপজেলার ১৬২ টির মধ্যে ১০০ টি, নলছিটি উপজেলার ১৬৫ টির মধ্যে ৮টি, রাজাপুর উপজেলার ১২৪টির মধ্যে ১টি ও নলছিটি উপজেলার ১৩২টির মধ্যে ১ টি বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন বসানো হয়েছে। সূত্রমতে গত অর্থবছরে এই কার্যক্রম শেষ করার কথা। কিন্তু তা না হওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে পরবর্তি কার্যক্রম শেষ করার কোন নির্দিষ্ট তারিখ বা সময় নির্ধারণ করেনি।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন ক্রয়ের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের যুগ্মসচিব রুহুল আমিন স্বাক্ষরিত পত্রে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। গত ২৩ অক্টোবর ১৮-১৬৮ নম্বর স্মারকে মহাপরিচালকসহ বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তাদের এ পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। পত্রে ১৫টি পদ্ধতি সংযুক্ত মেশিন ক্রয়ের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ৫টি পদ্ধতি যুক্ত নি¤œমানের মেশিন বিদ্যালয়ে স্থাপন করে এই অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এসবি। যুগ্মসচিবের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন কোম্পানিটির মাধ্যমে দ্রুত মেশিন বসানোর কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যে সব বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা মেশিন নিতে অপারগতা জানাচ্ছে তাদেরকে কোম্পানীর লোকজন শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে কালো তালিকাভূক্ত করার হুমকী দিচ্ছে বলেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষকরা জানান। খায়েরহাট ক্লাষ্টার ঝালকাঠি সদরের সহকারি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা সমীরেন্দু বিশ্বাসের ভূমিকাও বিতর্কীত। তিনি শিক্ষকদের মেশিন ক্রয়ে এ কোম্পানীর পক্ষে সহায়তা করার জন্য ফোনে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে শিক্ষকদের অভিযোগ।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি চৌপালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক মজিবুর রহমান জানান, সদর উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে একটি কোম্পানীর কাছে দেয়া তালিকা অনুযায়ী আমাদের বিদ্যালয়ে তারা এ মেশিন লাগিয়ে ২৯ হাজার ৫শ টাকা নিয়েছে। লেশপ্রতাপ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুননাহার জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিসের মাধ্যমে এসবি ট্রেডিং নামে একটি কোম্পানি আমাদের সাথে যোগাযোগ করে গত ৩১ অক্টোবর মেশিন লাগিয়ে দিয়েছে। মেশিনের দাম ২৯ হাজার ৫০০ টাকা বিদ্যালয়ের ফান্ডে না থাকায় আমার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাব থেকে চেকের মাধ্যমে এ টাকা পরিশোধ করেছি। আগরবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হাসিনা মমতাজ বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেছে এসবি নামে একটি কোম্পানি যাচ্ছে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন বসিয়ে দিতে। তাই তারা ২৮ অক্টোবর এসে মেশিন বসিয়েছে। শুনেছি তারা মেশিনের জন্য ২৯ হাজার ৫০০ টাকা নিয়েছে। কুতুবকাঠি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান এসবি কোম্পানি আমার বিদ্যালয়ে এসে উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে পাঠানোর কথা বলে মেশিন বসিয়ে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেছে। আমি ১৫ হাজার টাকা দিলে তারা বাকি টাকা পরে নিতে আসবে বলে জানায়। না দিলে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার ভয় দেখিয়ে হুমকী দেয়।
এ প্রসঙ্গে ঝালকাঠি উদ্বোধন প্রাথমিক বিদ্যালয় সভাপতি হাবিবুর রহমান হাবিল জানান, আমার বিদ্যালয়ে এসবি কোম্পানি এ মেশিন বসিয়ে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেছে। কিন্তু আমি প্রধান শিক্ষককে টাকা দিতে না বলায় তিনি দেননি। ১০ হাজার টাকার মেশিন লাগিয়ে অযৌক্তিক দাবি কোন ভাবেই মানা যায়না।
এসবি কোম্পানীর মার্কেটিং কর্মকর্তা পরিচয়ে মেসবাহ উদ্দিন বলেন, আমরা কোথাও জোর করছিনা। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ছালেহা খাতুনের অনুমতি নিয়েই আমরা এ কাজ শুরু করেছি। তিনি বলেছেন বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকদের বুঝিয়ে মেশিন লাগাতে। যারা আপত্তি করছে সেখানে স্থগিত রাখছি। ৩ বছরের ওয়ারেন্টি ও গ্যারান্টি দিয়ে এটা লাগাচ্ছি। প্রধান শিক্ষকরা অনেককিছু বোঝেনা। তাই তারা আপত্তি জানাচ্ছে। আমাদের মেশিন লাগানোর পর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এর কার্যক্রম পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলেও এই মার্কেটিং কর্মকর্তা জানান।
ঝালকাঠি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ছালেহা খাতুন এ প্রসঙ্গে তিনি কিছুই জানেননা বলে জনান। তিনি আরো বলেন কোন প্রধান শিক্ষক এখন পর্যন্ত তার কাছে এই কোম্পানীর বিরুদ্ধে তার কথা বলে মেশিন লাগানোর অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে তিনি ব্যবস্থা নিবেন বলেও জানান।
এ বিষয়ে ঝালকাঠি জেলা প্রাথমিক সহকারি শিক্ষা কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জানান, শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে হাজিরা নিশ্চিত করতেই সরকার এ উদ্যোগ নেয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটি স্লিপ ফান্ডের মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে নির্দেশনা অনুযায়ী বাজার থেকে মেশিনটি ক্রয় করবে। কিন্তু কোন কোম্পানি বিদ্যালয়ে গিয়ে উপজেলা শিক্ষ্ াকর্মকর্তা অথবা অন্য কারো রেফারেন্সে মেশিন বসিয়ে অধিক মূল্য আদায় করলে এ অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।