যথাযথ নিয়ম অমান্য করে দেশে অবাধে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে। আর জাঙ্গি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন ওসব রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করে বিস্ফোরক তৈরি করছে। লাইসেন্সধারী অসাধু ব্যবসায়ীরা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বেআইনিভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে। আবার অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে আদর্শগত কারণেও জঙ্গিদের কাছে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি ও সরবরাহ করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি ও অবৈধ অস্ত্র গোলাবারুদ ব্যবসায়ীর কাছ থেকেও নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরকের জোগান আসছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা বিস্ফোরক ভুয়া ভাউচারে সরিয়ে ফেলে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের কাছে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিস্ফোরক পরিদফতর ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বিস্ফোরক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, রাসায়নিক পদার্থ ও কেমিক্যাল (তরল) ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়মিত মনিটরিং নেই। বর্তমানে দেশে ৫৯ জন তালিকাভুক্ত বিস্ফোরক ব্যবসায়ী রয়েছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই বেআইনিভাবে বিস্ফোরুক বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। আর ওসব প্রতিষ্ঠান থেকে সংগৃহীত রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হচ্ছে শক্তিশালী হাতবোমা, ককটেল ও হ্যান্ডগ্রেনেড। তাছাড়া পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতীয় জঙ্গিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে মারাত্মক সব বিস্ফোরক।
সূত্র জানায়, পুলিশের পরিসংখ্যান মতে ২০০১ থেকে হালনাগাদ প্রায় ২৫ হাজার অস্ত্র-গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনায় প্রায় ১০ হাজার মামলা হয়েছে। তাতে গ্রেফতার হয়েছে অন্তত ৮ হাজার সন্ত্রাসী ও জঙ্গি। উদ্ধারকৃত অস্ত্র গোলাবারুদের মধ্যে প্রায় ৬ হাজার কেজি বিভিন্ন প্রকারের বিস্ফোরক ও ৩৩৪টি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক রয়েছে। এর বাইরে বিজিবির অভিযানেও বহু অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধারের ঘটনা ঘটলেও বিগত ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর মিরপুর থেকে বিপুল বোমা তৈরির সরঞ্জাম, গানপাউডার, শক্তিশালী বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থসহ জামায়াতে ইসলামীর এক সাবেক এমপি ও দলটির কেন্দ্রীয় নেতাসহ বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীফ কন্ট্রোলারসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়া বিগত ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সোয়া ৫ কেজি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ পুলিশের হাতে একটি এডুকেয়ার কোচিং সেন্টারের মালিকসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই দু’জনই ছিল বোমা ও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ। উদ্ধারক বিস্ফোরকগুলো পরীক্ষায় উচ্চমাত্রার বলে ধরা পড়ে। আর তা দিয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বোমা ও গ্রেনেড তৈরি সম্ভব ছিল বলেও গ্রেফতারকৃতরা স্বীকার করে।
সূত্র জানায়, বিগত ২০১৫ সালে ঢাকার বনানী ছাত্রশিবিরের বোমা তৈরির কারখানা থেকে ১৩০টি শক্তিশালী তাজা বোমা, পেট্রোলবোমা, গান পাউডার, জিহাদী বই ও চাঁদা প্রদানকারী জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের তালিকা উদ্ধার হয়। ওই ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেফতার হয়। ওই বছরের জুন মাসে ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের হাতে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হুজি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ৯ জঙ্গি গ্রেফতার হয়। উদ্ধার হয় উচ্চমাত্রার প্রায় ৬ কেজি বিস্ফোরক, বোমা তৈরির বিভিন্ন সরঞ্জাম, গ্রেফতারকৃতদের তৈরি ৮টি শক্তিশালী হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৬টি চকোলেট বোমা, চাপাতি, উগ্র মতবাদ প্রচারের বইপত্র ও সংগঠনের প্রস্তাবিত পতাকা। গ্রেফতারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি এবং বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিস্ফোরক তৈরির উপাদান পাচ্ছিল। ওই ঘটনার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গবেষণাগার ও বিস্ফোরক বা রাসায়নিক পদার্থ বিক্রির প্রতিষ্ঠানের ওপর কড়া মনিটরিং করার নির্দেশনা জারি করা হয়। তাছাড়া ২০১৫ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে ১২শ’ কেজি বিস্ফোরকসহ ৩ জন গ্রেফতার ও ঢাকার শাহ আলীর উত্তর বিশিলের একটি বাড়ি থেকে ৪০ কেজি খুবই উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক, অত্যাধুনিক ম্যাগজিনসহ ১টি এসএমজি (স্মল মেশিন গান), ১টি বিদেশী অটোমেটিক পিস্তল, ১টি তাজা গ্রেনেড, বোমায় ব্যবহৃত ২৫টি টাইমার, তিন ব্যাগ বোমার স্পিøন্টার ও নাইন এমএম পিস্তলের ১৮ রাউন্ড তাজা বুলেট, ৩৬টি গ্রেনেডের খোলস, টাইম বোমায় ব্যবহৃত শতাধিক ঘড়ি, বোমা তৈরির ফর্মুলা, গ্রেনেড তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম ও প্রচুর জিহাদী বই উদ্ধারের বিষয়টি আলোচিত ঘটনা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, বিভিন্ন সময় উদ্ধারকৃত বিস্ফোরকগুলো সাধারণত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ব্যবহার করতে দেখা যায়। ওসব বিস্ফোরক দিয়ে আর্জেস গ্রেনেডের সমশক্তি সম্পন্ন একহাজার স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী টাইমার গ্রেনেড তৈরি সম্ভব। উদ্ধারকৃত তিন ধরনের বিস্ফোরকের তৈরি গ্রেনেড সাধারণত পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও শ্রীলঙ্কান জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ব্যবহার করে থাকে। তাছাড়া এমন শক্তিশালী বিস্ফোরক সাধারণত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী ও আল কায়েদার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ব্যবহার করে। স্বল্প সময়ে একসঙ্গে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে, গাড়িসহ মানুষজন উড়িয়ে দিতে, বড় ধরনের ভবন গুঁড়িয়ে দিতে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো এসব বিস্ফোরক ব্যবহার করে। বিশেষ কাউকে নিশ্চিতভাবে হত্যা করতে সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যদেরও এ জাতীয় বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি বোমা ব্যবহার করার নজির রয়েছে।
এদিকে বিস্ফোরক পরিদফতরের তথ্য মতে, ঢাকায় আতশবাজি বা এ জাতীয় বিস্ফোরক বিক্রির দোকানের সংখ্যা ৫৯টি। দোকানগুলো কী পরিমাণ স্বল্প ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক আমদানি করে এবং বিক্রি করে তা মনিটরিং করার কথা। সরকারি হিসাব অনুযায়ী তারা কত বিস্ফোরক এনেছে এবং বিক্রি করেছে তার ফিরিস্তি দেয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই।
অন্যদিকে গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, রাসায়নিক পদার্থের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কেমিক্যাল বিক্রির দোকান ছাড়াও ঢাকার কয়েকটি ম্যাচ ফ্যাক্টরি থেকেও নাশকতায় ব্যবহৃত বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থের জোগান আসছে। তাছাড়া বাংলাদেশ ভারত স্থল সীমান্তের অস্ত্র গোলাবারুদ চোরাকারবারিদের কাছ থেকেও জঙ্গিরা বিস্ফোরক সংগ্রহ করে। ঢাকা থেকে সংগৃহীত বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হচ্ছে হাতবোমা, ককটেল আর হ্যান্ড গ্রেনেড। আর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারতীয় জঙ্গিদের মাধ্যমে স্থল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসা উচ্চমাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরি হয়।
বিস্ফোরক তৈরির উপাদান বিক্রি প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ- ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিআইজি মনিরুল ইসলাম জানান, স্কুল-কলেজ বা কোন প্রতিষ্ঠানের জন্য রাসায়নিক দ্রব্য কিনতে হলে ওই প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত প্যাডে বা ওই প্রতিষ্ঠান প্রধানের সইসহ কাগজ জমা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। আর জমা দেয়া কাগজপত্র যাচাই বাছাই শেষে রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি বা সরবরাহের নিয়ম। কিন্তু দোকান মালিকরা ওসব যাচাই বাছাই না করেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ বিক্রি করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ল্যাব সহকারী নিজেকে প্রাক্তন ছাত্র পরিচয় দিয়ে দোকান থেকে বিস্ফোরক তৈরির রাসায়নিক পদার্থ সংগ্রহ করতো। আর গ্রেফতারকৃতরা সবাই আইএসের অনুসারী।