ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় মাদকের ড্যান্ডি খ্যাত রাজশাহী অঞ্চল এখনও নিয়ন্ত্রণহীন। বিপুল পরিমাণের মাদকের চাহিদার যোগান দিতে পাল্লা দিয়ে এখানে বাড়ছে মাদক ব্যাবসায়ীর সংখ্যা। আর এ কাজে সাধারণ মানুষের সাথে যোগ হয়েছে নামধারী কিছু হিজড়া। এক্ষেত্রে রাজশাহীতে সরকারের জিরো ট্রলারেন্স নীতির ধারাবাহিকতা না থাকায় কোন কাজেই আসছেনা বলে অভিমত রয়েছে। সম্প্রতি কয়েকজন মাদক কারবারী অভিযানে নিহত হলেও এখন তা বন্ধ থাকায় ফের সংক্রিয় হয়ে উঠেছে।
বে-সরকারী একটি সংস্থার জরিপ মতে, প্রায় শতাধিক হিজড়া গোষ্টি বর্তমানে মাদকদ্রব্যের ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে গেছে। আর বাকি প্রায় দুই শতাধিক হিজড়ারা তাদের এ কাজে সহযোগিতা করছে। তারা এ ব্যবসার পাশাপাশি যৌন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিজেরাও মাদক সেবন করে থাকে। যে কারণে এদের সাথে দৈহিক মেলামেশায় মরণ ব্যাধি এইডসসহ নানা ধরনের রোগ ছড়ানোরও আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার টাঙ্গন, ইউসুফপুর, পিরোজপুর, রাওথা মীরগঞ্জ ও গোদাগাড়ী উপজেলার চরআষাড়িয়াদহ, চরভুবনপাড়া, চরকানাপাড়া, আমতলা, কোদালকাটি কদমহাজীর মোড়সহ অন্যান্য পয়েন্ট দিয়ে মাদকদ্রব্য আসছে। এক শ্রেণীর দালালরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চোরাচালানীদের অবৈধ মালামাল পাচারে সহযোগিতা করছেন। যে কারণে মাদক ব্যবসা বা পাচার কোনভাবেই বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে অভিমত রয়েছে। এ কারণে যুব সমাজ হচ্ছে বিপদগামী, নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা বিরাজ করায় অভিভাবক মহলে চরম তোলপাড় শুরু হয়েছে। চোঁখের সামনে দিয়ে একমাত্র সন্তান নেশাগ্রস্থ হয়ে বিপথগামী হয়ে পড়লেও অভিভাবকদের যেন কোন করণীয় নেই। তাই মাদক বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহনের দাবী করেছেন রাজশাহীর সর্বস্তরের অভিভাবকরা।
নামপ্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মাদক ব্যবসায়ী জানান, গোদাগাড়ী ও চারঘাট-বাঘা এলাকাতে মাদক ব্যাবসায়ীর সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। প্রায় সারাদেশের মাদকের যোগান দিতে প্রশাসনের চোঁখ ফাঁকি দিয়ে অথবা ম্যানেজ করে মাঠ পর্যায়ে মাদকের ব্যাবসায়ীক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মাদকের ব্যাবসা থেকে পিছিয়ে নেই চা-স্টল ও মুদি দোকানীরাও। লোক দেখানো দোকানের আড়ালে চলছে তাদের মাদক বিক্রির মহোৎসব। দিনকে দিন বাড়ছে প্রাপ্তবয়স্কের পাশাপাশি অপ্রাপ্তবয়স্ক মাদকসেবীর সংখ্যা। বর্তমানে স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদেরও মাদকের অবাধ বিক্রি ও সেবনের ফলে নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। যুবক-যুবতি, ছাত্র-ছাত্রী, শ্রমিকসহ সর্বস্তরেই ছড়িয়ে গেছে মাদকের ব্যবহার। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন পর্যায়েও রয়েছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী অফিসের কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পথের টোকাইরাও মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে।
সুত্র মতে, রাজশাহী নগরীর গুড়িপাড়া, কাশিয়াডাঙ্গা, ভাটাপাড়া রেললাইন বসতির অলি গলি থেকে শুরু করে অভিজাত এলাকার সর্বত্রই ঘটেছে মাদকের বিস্তার। এমন কোন পাড়া মহল্ল¬া নাই যেখানে মিলবে না মাদকদ্রব্য। পুলিশ প্রশাসনের অসাধু কর্তাবাবুদের ম্যানেজ করেই চলছে মাদক ব্যবসা ও সেবন কার্যক্রম চলছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মাদকের বিস্তার রোধে আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রতিটি মিটিংয়েই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও উল্লেখযোগ্য ফলাফল নেই বললেই চলে। অভিযোগ রয়েছে, প্রসাশনের সাথে সাপ্তাহিক বা মাসিক চুক্তির বিনিময়ে মাদক ব্যবসায়ীরা অনেকটা নিরাপদেই চালিয়ে যাচ্ছে তাদের ব্যবসা। যারা এ চুক্তির বাইরে রয়েছে তারাই শুধু গ্রেফতার হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ ও র্যাবের একাধিক কর্মকর্তা জানান, প্রসাশনের কর্তাবাবুরা জড়িত থাকার কারণেই মাদক বন্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নাই।
এদিকে মাদকের ভয়াল থাবায় তারুণ্য, মেধা, বিবেক, লেখাপড়া ও মনুষ্যত্ব-সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করছে স্নেহ-মায়া, ভালোবাসা ও পারিবারিক বন্ধন। মাদকের টাকা যোগাড় করতে ছিনতাই, চুরিসহ খুন করার ঘটনাও ঘটে। রাজশাহী অঞ্চলে মাদক জগতে এখন শীর্ষে রয়েছে ইয়াবা, হেরোইন ও ফেনসিডিল।
দিনের আলো হিজড়া সংগঠনের সভাপতি মিস মোহনা জানান, ‘আমাদের সম্প্রদায়ের অনেকেই মাদকাসক্ত হয়েছে কথাটি মিথ্যা নয়, রীতিমত মাদক ব্যবসাও পরিচালনা করে যাচ্ছে। বিভিন্ন বাসায় গিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে অর্থ উপার্জন করছে। তবে তারা আমাদের সংগঠনের সদস্য নয়, বাইরে থাকা দুই শতাধিক হিজড়া রয়েছে, যাদের বেশীর ভাগই এসব অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যাদের কারণেই বদনাম হচ্ছে। ফলে তাদেরকেও আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।’
রাজশাহী জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইফতে খায়ের আলম জানান, ‘প্রতিদিনই মাদকদ্রব্য উদ্ধারসহ মাদকের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। সকল শ্রেনী পেশার মানুষরাই মাদক ব্যবসায় জড়িত। কিন্তু কে কোন লিঙ্গের অপরাধী তা আলাদাভাবে দেখার সুযোগ নাই। তাদের একটাই পরিচয় তারা অপরাধী। যে কারণে অপরাধের সম্পৃক্ততা থাকলে কোন ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। বিশেষ করে মাদকের ক্ষেত্রে তো নয়-ই।’