যাত্রী পরিবহন বৃদ্ধি, নতুন কিছু সেবা চালু এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধিও পরও কমেছে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয়। রেলওয়ের আয়ের প্রধান দুটি উৎস হলো যাত্রী ও পণ্য পরিবহন খাত। রেলওয়ের গত অর্থবছরের আয় খাত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওই সময় অন্যান্য খাতে বাড়লেও মূলত এ দুটি খাতেই আয় কমেছে। অথচ এসময়ে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ট্রেনগুলো বিপুল আয় করেছে। গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) রেলের মোট আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় ৮ কোটি টাকা কম। তবে গত অর্থবছওে আয় কিছুটা কমলেও আগের দুই অর্থবছরে রেলওয়ের আয় ছিল তুলনামুলক বেশি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল প্রায় ৯০৪ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এক ধাক্কায় ৪০০ কোটি বেড়ে আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ হাজার ৩০৪ কোটি টাকায়। এরপর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পায় আরো ১৮২ কোটি টাকা। ওই সময় রেলওয়ের মোট আয় হয়েছিল প্রায় ১ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৮ কোটি টাকা হ্রাস পেয়ে গত অর্থবছরে আয়ের পরিমাণ নেমে আসে প্রায় ১ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকায়। ফলে রেলওয়ের সার্বিক আয়ে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছরই রেলের বহরে নতুন নতুন ট্রেন যুক্ত হচ্ছে। পণ্য পরিবহন খাতেও ব্যবসায়িক ও সরকারি প্রয়োজনেও রেলের ব্যবহার বেড়েছে। ভাড়া বাড়লেও সা¤প্রতিক বছরগুলোয় যাত্রীদের মধ্যে রেলভ্রমণের আগ্রহও বেশি দেখা যাচ্ছে। বাড়ানো হয়েছে রেল বহরের কোচ সংখ্যাও। রেলওয়ের অবকাঠামো খাতে গত এক দশকে সব মিলিয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় করেছে সরকার। তাছাড়া ট্র্যাক উন্নয়ন, নতুন রেলপথ নির্মাণের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ লোকবলও নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু এতো কিছুর পরও সেবার মানে নতুনত্ব আনতে না পারায় বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় আয় করতে পারছে না।
সূত্র জানায়, রেলওয়ের হিসাব বিভাগ থেকে স¤প্রতি রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলভবনে সংস্থাটির আয়ের হিসাব পাঠানো হয়। তা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেলওয়ের যাত্রী খাতে আয় হয়েছে ৮৮২ কোটি ৫৩ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এর আগে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এ খাতে আয়ের পরিমাণ ছিল ৯০৫ কোটি ৩০ লাখ ৩১ হাজার টাকা। গত অর্থবছরে পণ্য পরিবহন খাতে রেলওয়ের আয় ছিল ২৬৬ কোটি ৯ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ২৮৫ কোটি ৯৪ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। তাছাড়া গত অর্থবছরে পার্শেল খাতে ২৪ কোটি ৫২ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও বিবিধ খাতে ৩০৪ কোটি ৭৭ লাখ ৫১ হাজার টাকা আয় করেছে রেলওয়ে। ওই দুটি খাতেই আয়ের ধারা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। অথচ ওই সময়ে বেসরকারি খাতে পরিচালিত ট্রেনগুলো বিপুল আয় করছে। মূলত রেলের আয় কমে যাওয়ার পেছনে অব্যবস্থাপনা অনেকাংশে দায়ি। কারণ এখনো শত শত যাত্রী বিনাটিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করার সুযোগ পায়। বিশেষ করে ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ, ঢাকা-নেত্রকোনা, ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, ঢাকা-দিনাজপুর, ঢাকা-চিলাহাটি, ঢাকা-রংপুর-লালমনিরহাট-কুড়িগ্রাম রুটে অসংখ্য যাত্রী বিনাটিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করছে। অভিযোগ রয়েছে, ওসব রুটে চলাচলকারী ট্রেনের পরিচালক (গার্ড), এটেনডেন্ট ও পুলিশ সদস্যরা যাত্রীদের কাছে থেকে টাকা নিয়ে বিনাটিকিটে ভ্রমণের সুযোগ করে দিচ্ছে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচিত্র বহু অভিযোগ দেখা গেছে। কিন্তু তারপরেও দুর্নীতিবাজ রেলকর্মচারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাতে বিনাটিকিটের যাত্রীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
সূত্র আরো জানায়, রেলের আয় কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে ইঞ্জিন স্বল্পতা। ইতিমধ্যে রেলের উন্নয়নে অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ইঞ্জিন। সেটি না থাকায় রেলওয়ে কার্যত ধুঁকছে। কোচ আমদানি, ট্র্যাক সংস্কার ও নতুন ট্র্যাক নির্মাণ হলেও ইঞ্জিন স্বল্পতায় রেলের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। ওই কারণে যাত্রী পরিবহন স্বাভাবিক থাকলেও পণ্য পরিবহন ধীরে ধীরে কমে আসছে। তাছাড়া অতিরিক্ত কোচ সংযোজনে রেলভবন থেকে অনুমতি নেয়ার নিয়মটিও রেলওয়ের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির অন্তরায়। রেলওয়ের ইঞ্জিন সঙ্কট বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে যাত্রী চাহিদা থাকলেও নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালাতে পারছে না রেলওয়ে। তাছাড়া গত কয়েক বছরে ট্রেন পরিচালনার ওয়ার্কিং টাইম টেবিল বাস্তবায়ন না করায় রেলওয়ে সেবার মানেও পিছিয়ে পড়ছে।
এদিকে সড়কপথের দ্রুত উন্নতিও রেলওয়ের আয় হ্রাসের ক্ষেত্রে কিছুটা অনুঘটকের কাজ করেছে। এক সময়ের ব্যস্ততম রেলরুট ঢাকা-চট্টগ্রামে রেলওয়ের যাত্রী চাহিদায় এখন কিছুটা মন্দাভাব দেখা যাচ্ছে। ওই রেলপথের ৩২১ কিলোমিটারের সিংহভাগ ডাবল লাইন হয়ে যাওয়ার পরও দ্রুতগামী ট্রেনের গন্তব্যে পৌঁছতে ন্যূনতম সময় লাগে সোয়া ৫ ঘণ্টা। রেলওয়ের পক্ষ থেকে ওই রুট যাতায়াতের (বিরতিহীন ট্রেন) সময় সাড়ে ৪ ঘণ্টায় নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। অন্যদিকে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি এলাকার মহাসড়কগুলো চার লেনে উন্নীত হয়েছে। ফলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি স্থানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক যাত্রী এখন রেলের বদলে সড়কপথকেই বেছে নিচ্ছেন।
এদিকে এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জানান, যাত্রীদের নিরাপত্তা ও সেবার মান বাড়াতে গিয়ে অনেক কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য ব্যয় কিছুটা বেড়েছে। এ অবস্থা থাকবে না। এক সময় রেলই হবে সবচেয়ে লাভজনক সেক্টর।