চাঁদকে মনে হচ্ছে ভোরের মৃদুসূর্য। এ আলোয় ডুবে ডুবে অনেকদিন জুঁইদের বারান্দায় গিয়ে হাজির হয়েছে সে। মনে পড়তেই একচোট হেসে নেয়। আগে বারান্দায় যেত; এখন ছাদে। কিন্তু চাঁদ ছিল, রাত ছিল, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ছিল, বুকের ধরফরানি ছিল এমনই। সময়টা একটু এগিয়ে রাত ১১টা হয়েছে কেবলমাত্র। কারন হিসেবে বিথি বলেছে ওর বাবার ঘুমের কথা। ওর বাবা ডাক্তার মানুষ; সারাদিন রুগী দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে ফেরেন রাত ৯টা, সাড়ে ৯টায়। মা-ও ওই একই সময় বাসায় ফেরেন। খাওয়া দাওয়া সেরে তাদের ঘুমুতে যেতে যেতে রাত সাড়ে ১০টা বেজে যায়। কৌশলে সরিয়ে রাখা চাবি হাতে এগিয়ে আসছে বিথি। সামনেই ছায়ামূর্তি। সাবধানে নখ টিপে টিপে পা ফেলে সে। তারপর ঠান্ডা হাত দিয়ে টেনে সামনে নিয়ে যায় ছায়ামূর্তিটিকে। তখনও বিথির বুক ঢিবঢিব করছে ভয়ে। কখন আবার কি সমস্যা হয়ে যায়। কোন সমস্যার প্রেতাত্মা এসে দাঁড়ায় এই নিবিড় সময়ে। আতঙ্কে আতঙ্কে কেটে যায় চাঁদমাখা সময়গুলো। পায়জামার ফিতা বাঁধতে বাঁধতে উঠে দাঁড়ায় বিথি। কিন্তু ছায়ামূর্তিটি নির্জিব হয়ে পড়ে আছে। আজানের প্রস্তুতি পর্ব চলছে যান্ত্রিক শব্দকোষে। কোন কোন শব্দকোষ ভাসিয়ে দিচ্ছে এলোপাতারি ঘুমছড়ানো কাশি, কোন কোনটায় উর্দু গজলের রেশ। টানা হেচড়ার আচমকা আক্রমনে ঘুম ভাঙে আসলামের। অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে আসা পা-দেহ যখন একটু বেহেশতি স্বাদ পেয়েছে; অমনি পরম তৃপ্তিতে হেলে পড়েছে জিব্রাইলের কোমল ডানায়। যে কারনে রাজ্যের ঘুমক্রমে এগিয়ে যাচ্ছিল ভোরের দিকে। আর তখনই এই আক্রমন। কানের কাছে মুখ এনে বিথি বলে বাবু। এখন ওঠো, তা না হলে আব্বু-আম্মু জেগে যাবে। আসলাম খুব আহ্লাদের সাথে বলে, জাগুক। জাগুক মানে? সর্বনাশ তুমি কি এখনই সব হারাতে চাও? প্রশ্নের পর প্রশ্নের জাল বোনা দেখে আসলাম বুঝতে পারে বিথির বয়ে চলা স্রোত আবার বেড়ে যাওয়ার জোগার হয়েছে। তাই কথা না বাড়িয়ে উঠে বসে। তারপর কিছুক্ষন আবার এলোমেলো আদরের দোলনা দোলা; অত:পর বিনম্র সুখের স্বপ্নছুটি। ছুটির দেয়ালে পড়ে দুঃখের জ্যোস্না। ঢুলু ঢুলু চোখে হাটছিল আসলাম। তার কাছে চাঁদটা বরাবরই সক্ষ্যি সাক্ষ্যি মনে হয়। কাশীপুইর্যা সাক্ষি। দেখলেও দেখছে, না দেখলেও দেখছে। আসলামের প্রতিটি নিশিকর্মের সাক্ষ্যি এই চাঁদ। যখন মা ছিল না; মায়ের পরিবর্তে উপ-মা নিয়ে বাবার বিছানা যখন দুলে উঠতো তখনো এই চাঁদ ছিল, যখন আসলাম নিজে চাচাতো বোনের ভালোবাসর ফাঁদে নিজেকে সপেঁ দিত তখনো এই চাঁদ ছিল; গলে গলে পড়তো চাঁদের মায়াবী আদর। কখনো বাবার গায়ে কখনো তার। এভাবেই চাঁদকে খুব আপন করে নিয়েছে সে। চাঁদ জানে ভালোবাসার রোদে দুঃখের শীত পোহাতে আসলাম এবার যাযাবর থেকে গৃহস্থ হবে। তার এখন দু’চোখ ভরা আশার জোয়ার। এ জোয়ারে মাঝে মাঝে ভেসে যেতে ইচ্ছে করে তার। মনে হয় জোনাকি পোকার মত উড়ে যায়। চাঁদের আলোয় নগ্ন মায়ায় হাসে। একা একাই হেসে উঠে সে। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে; সেখানে দাঁড়িয়েই গতকাল আদরের সবটুকু স্বপ্ন বুনেছে। আদরের বীজ বুনলে আদরের বৃক্ষ হবে। এই বৃক্ষমঙ্গল, এই বৃক্ষামায়ায় পড়ে তার বিথি চিরদিন তার হবে। প্রত্যয়ের ক্যানভাসে দু’জনের স্কেচ আঁকে আসলাম। চারুকলার ছাত্র হিসেবে নিজেকে সে শিল্পী রুপান্তরিত করতে পারতো। অনেক লম্বা সুযোগ ছিল তার। কিন্তু করেনি। তারপরও বন্ধুরা তাকে চারু আসলাম বলেই ডাকে। চারু আসলাম নামের আড়ালে সে বিনোদন হয়ে ওঠে নিরব রাতে। রাতের দেয়ালে চাঁদ আর ফাঁদ নিয়েই আসলামের বর্তমান। এলাটিং বেলাটিং ভাবছিল সে; ঠিক তখনই প্রতিদিনের মত একটি ছায়াকে এগিয়ে আসতে দেখে আসলাম। তবে আজ একটু মোটা মোটা, একটু লম্বা লম্বা মনে হচ্ছে ছায়াটিকে। মন বলছিল, আসলাম আজ বিথি আসেনি; তুমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যাও। মনের কথায় মোটেই সায় দেয়নি সে। আরো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিমগ্ন দর্শকের মত এগিয়ে আসা দেখতে থাকে। ভাবতে থাকে, আজ ছিল স্বাধীনতার দিবস। ১৯৭১ এ আজকের এই দিনে পাক হায়েনা আর রাজাকার আলবদরেরা হয়েছিল হিংস্রতার শীর্ষবাহিনী। চালিয়েছিল অমানবিক আর অযাচিত কষ্টের চাকা। এই চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছেন অসংখ্য শহীদ। সেই শহীদদের প্রাণের বিনিময়ে সচেতন হয়েছে মানুষ। সাহসের সাথে লড়েছে প্রকৃত যোদ্ধারা। যার বিনিময়ে আজকের এই দেশ, এই বর্তমান। এই বর্তমানের উপর চলছে কতরকম অন্যায়? প্রশ্নের জাল বুনলেও উত্তর আর খঁজে পায় না। তারপরও এগিয়ে যায়। এগিয়ে যায় রাজাকার চক্রের ফাঁসীর দাবী সম্বলিত ব্যানার হাতে। যার গায়ে বড় বড় করে লেখা ‘একাত্তরের প্রতিটি যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসী চাই’। চারু তার আর বিথির আজকের দিনের কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করছিল। ক্যাম্পসে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভা, কবিতা পাঠ, রক্তদান কর্মসূচীসহ প্রায় সকল কাজে সারাদিন দু’জন একসাথেই ছিল। ফেরার পথে বরাবরের মত আজকেও ফুটপাতে গাড়ি পার্ক করে রেখে দু’জন রাস্তার দু’ধারে জমিয়ে তোলা পসড়া সাজানো দোকানের ক্রেতা হয়েছিল। খুবই সাধারণ একজোড়া স্যান্ডেল কিনেছিল বিথি। বাবা-মায়ের আভিজাত্যপূর্ণ জীবন যাপনকে কখনোই গ্রহন করেনি সে। যে কারনে আসলামের দিকে আসা। রাস্তার দু’ধারের দোকান থেকেই কেনা তার পায়জামা,পায়জামার ফিতেটাও পথের। পথের প্রতি বিথির প্রচন্ড টান থেকেই আসলামকে সে কাছে ডেকেছিল। এই কাছে থাকার স্বীকৃতি পাবে কি না। তা নিয়ে মোটেই চিন্তিত না বিথি। কিন্তু আসলাম চিন্তিত। ভাবছে এগিয়ে আসা এই ছায়াটি কি বিথির, না অন্যকারো? না বিথির বড়বোন সুযোগে সদ্ব্যবহার করতে যাচ্ছে? ইতিও আসলামকে চেয়েছিল যে কোন মূল্যে, অনেক ঘুরেফিরে বেচারা শেষে হতাশ হয়েই ফিরে গিয়েছিল। আজকে তার প্রতিশোধ নিতে বিথিকে কোথাও কোনভাবে আটকে রেখে সে চলে আসছে? প্রশ্নের পর প্রশ্ন বুনে যাচ্ছে নতুন জালা বোনার মত করে। কেননা, ইতি তাকে বলেছিল, আসলাম তোমার মধ্যে যা আছে, তা আমি একদিন হলেও দেখে নেব। ভয়ে আসাঢ় হয়ে আসে আসলামের পা থেকে মাথা। বিথি না, ইতিই হবে। অনেকটা নিশ্চিত হয় সে। বিথির স্বাস্থ্য এতটা ভালো না। লম্বায়ও এত উঁচু না। তাহলে কি আজই ধরা পড়ে যাবেই, স্বপ্নের পতন ঘটবেই? ভাবতে ভাবতেই সেই পরিচিত হাত আঁকড়ে ধরে। সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, একটু দেরি হয়ে গেলো দোস্ত। বিথির এই ডাকের ভেতর তলিয়ে যেতে থাকে আর অনুভব করে আজ দুপুরে আসলাম তার পত্রিকায় প্রকাশিত লেখার বিলের টাকায় যে সোয়েটারটা কিনে দিয়েছিল; তা তাকে আলিঙ্গন করছে সকল অসমতা ভুলে...