সারাদেশে সড়ক-আকাশ- নৌ ও রেলপথ নিয়ে একের পর এক কর্মসূচী করে যাচ্ছি ছাত্র জীবন থেকে। ২০০৭ সালের সেই দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলা শুরু করেছি। এখনো সেই ধারাবাহিকতা অব্যহত রেখে এগিয়ে চলছি। এই চলায় কোন বৌ হারানোর বেদনা নয়; বরং যাতে আর কোন স্বজন না হারাতে হয়; এজন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছি।
যদিও ইদানিং সড়কপথ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ ও সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে চারটি কমিটিকে দু’মাস সময় দেয়া হয়েছে। ১১১ দফা সুপারিশ বাস্তবায়নে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে চারটি কমিটি গঠন করে এ সংক্রান্ত টাস্কফোর্স। এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চার কমিটির কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আবারও বৈঠকে বসবে টাস্কফোর্স।
সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে- সড়কপথপথ পরিবহন আইন কার্যকর রয়েছে; স্থগিত করা হয়নি। শুধু কয়েকটি জায়গায় ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
অবশ্য সড়কপথ পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা আনা ও দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গঠিত শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি ১১১ দফা সুপারিশ করে। ৫ সেপ্টেম্বর সড়কপথ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সভায় ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে ১৬ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে ৩৩ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। রোববার টাস্কফোর্সের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব তিনজনকে কো-অপ্ট করা হয়। সভায় চারটি কমিটি গঠন করা হয়। এনফোর্সমেন্ট সংক্রান্ত সুপারিশ বাস্তবায়ন ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সংক্রান্ত জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এই যখন দেশের অবস্থা। তখন জানতে পেরেছি- চলতি অর্থবছরসহ গত ৫ অর্থবছরে রেল খাতে ৬৪ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও দুর্ঘটনা যেন পিছু ছাড়ছে না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ২০ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা বাদ দিলে বাকি ৪৩ হাজার ৯৮৯ কোটি টাকাই বিনিয়োগ করা হয়েছে রেলের উন্নয়নে। অথচ বেসরকারি হিসাবে গত ৮ বছরে রেলের ছোট-বড় দুর্ঘটনার সংখ্যা প্রায় ১৪শ’। এতে প্রাণ হারায় প্রায় আড়াইশ’ যাত্রী। সাম্প্রতিক সময়ে রেলে যেন দুর্ঘটনার হিড়িক পড়েছে। নিরাপদ বাহন রেল এখন হয়ে উঠছে অনিরাপদ বাহনে। একের পর এক নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হলেও সংস্কারে গুরুত্ব না দেয়ার খেসারত এখন দিতে হচ্ছে দুর্ভাগা যাত্রীদের। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছেন, দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় বরাদ্দও। অবশ্য সম্প্রতি রেলের উন্নয়ন নিয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক হয় রেল মন্ত্রণালয়ে। সেখানে রেলের উন্নয়ন নিয়ে নানামুখী আলোচনা ওঠে আসে। ওই বৈঠকে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, রেললাইন সঙ্কুচিত হচ্ছিল। যতদূর জানতে পেরেছি- প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে নতুন কয়েকটি লাইন চালুর পাশাপাশি প্রায় ৩৩১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ সংযোজন করা হয়েছে। নতুন রেলস্টেশন নির্মাণ ও পুরনো লাইন মেরামত করা হচ্ছে। এ সময় তিনি রেলের সেবা বৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করেন। সর্বশেষ ১৪ নভেম্বর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন ও ৭টি বগি লাইনচ্যুত হলে তাতে আগুন ধরে আহত হন ২৫ জন। এর দু’দিন আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষে ১৬ জন প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক। গণমাধ্যমের সূত্র থেকে জেনেছি- গত ২৩ জুন রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে প্রাণ হারান ৫ জন। আহত হন শতাধিক যাত্রী। এছাড়া ছোটখাটো লাইনচ্যুতির ঘটনা তো আছেই। সূত্র বলছে, ২০০৯-১০ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত মেইন ও শাখা লাইনে ১ হাজার ৩৯১টি রেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ২০৩ জন নিহত ও ৫৮৬ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৩০৮টি, ২০১০-১১ অর্থবছরে ২২৪টি, ২০১১-১২তে ১৮২টি, ২০১২-১৩তে ১৭৬টি এবং ২০১৩-১৪তে ২০৩টি দুর্ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়ন কর্মকান্ডে বড় ধরনের ব্যয় করা হলেও দুর্ঘটনা প্রতিরোধ ও নিরাপদ বাহন হিসেবে রেলকে খুব বেশি আকর্ষণীয় করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি রেল খাতে অনেক অর্থ ব্যয় হয়েছে। গেল ডিসেম্বরে শেষ হয় খুলনা ও ইয়ার্ড রিমডেলিং এবং বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশনের অপারেশনাল সুবিধার উন্নয়ন কাজ। গত জুনে শেষ হয়েছে পাটুরিয়া-ফরিদপুর-ভাঙ্গা রেলপথ পুনর্বাসন ও নির্মাণ প্রকল্প। একই সময়ে সমাপ্ত হয়েছে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে চালারচর পর্যন্ত নতুন ৭৮ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ। প্রায় ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ঈশ্বরদী-জয়দেবপুর সেকশনের ৪টি স্টেশন নির্মাণ ও তৃতীয় লাইনগুলোতে কম্পিউটারবেইজড ইন্টারলকিং করা হয়। এছাড়া রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের লেভেল ক্রসিং ও গেটগুলোর পুনর্বাসন ও মান উন্নয়ন করা এবং ১০০টি মিটারগেজ যাত্রীবাহী বগি কেনা হয়। পাশাপাশি মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ কাজের পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
রেল খাতের অধিকাংশ ব্যয় হচ্ছে উন্নয়ন ও বেতন-ভাতা খাতে। সংস্কারে খুব বেশি বরাদ্দ হচ্ছে না। শুধু ক এখানেই শেষ! ব্রিটিশ আমলের রেললাইন নিয়মিত সংস্কারের প্রয়োজন থাকলেও সেগুলো ঠিকমতো হচ্ছে না। পাশাপাশি অনেকদিন ধরেই রেলের জনবল কম। ১৯৯১ সালে তৎকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর একসঙ্গে ১০ হাজার স্টাফকে ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে’ বিদায় করার পর সেভাবে জনবল নেয়া হয়নি। আর সংশ্লিষ্টরা বলছেন- প্রতি বছরই রেলে বাজেট বাড়ছে। এর বড় অংশই ব্যয় হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকান্ডে। সংস্কার ও মেরামতে ব্যয় হচ্ছে কমই। তবে রেল এমন একটি পরিবহন, যার নার্সিং সব সময় প্রয়োজন। বিশেষ করে সিগন্যাল লাইন, পাথর বিছানো, রেললাইন সংস্কার ও বিভিন্ন ধরনের কাজসহ সবকিছু হালনাগাদ রাখতে হয়। সেই হিসাবে বাজেটে সংস্কার খাতে বরাদ্দ কম থাকে। সংস্কার খাতে বাজেট বাড়ানোর পাশাপাশি বরাদ্দ অর্থ সঠিক ও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে; যাতে অর্থের কোনো অপচয় না হয়। সূত্র জানায়, রেল খাতের উন্নয়নে চলতি অর্থবছরে ১২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ১১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যথাক্রমে ৫৬৫ কোটি টাকা, ৯ হাজার ১১৫ কোটি ও ১০ হাজার ৮১৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়। বাকি ২১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে বেতন-ভাতা ও পরিচালনা খাতে। রেল খাতে ব্যয় ও রেলপথ বাড়লেও দীর্ঘদিনের পুরনো লাইনগুলো ঠিকমতো সংস্কার না করায় রেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। রেলপথে ছোট-বড় ৩ হাজার ১৪৩টি কালভার্ট-ব্রিজের অধিকাংশই ব্রিটিশ আমলের। সংস্কার না করায় এর ৪০২টি সেতুই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
রেল দুর্ঘটনা রোধে বিশ্বব্যাপী নানা প্রযুক্তির প্রয়োগ হলেও আমাদের দেশে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। পার্শ্ববর্তী ভারতে ট্রেনের মুখোমুখি দুর্ঘটনা রোধে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে। সেখানে কোনো রেললাইনে দুটি ট্রেন মুখোমুখি চলে এলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্রেন বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও আমাদের দেশে রেলে অভিজ্ঞ চালকের অভাব আছে। নতুনদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়েই চালকের আসনে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। চালক সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে। সেভ দ্য রোড-এর গবেষণা অনুযায়ী- রেল দুর্ঘটনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণ হলো, অরক্ষিত রেলক্রসিং। সারা দেশে ২ হাজার ৯৫৫ কিলোমিটার রেলপথে লেভেল ক্রসিং রয়েছে ২ হাজার ৫৪১টি। এর অর্ধেকের বেশি লেভেল ক্রসিং অরক্ষিত। এগুলোতে কোনো প্রহরী নেই। এসব লেভেল ক্রসিংয়ে শুধু ‘সামনে রেলক্রসিং, সাবধানে চলাচল করুন’ সতর্কীকরণ সাইনবোর্ড ঝুলিয়েই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ বলছে, রেল মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে স্থানীয় জনগণ দিন দিন লেভেল ক্রসিং বৃদ্ধি করেই চলেছে, তাই সব লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যান দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। আর এমন পরিস্থিতিতেই এগিয়ে চলছে ছলাকলার রেলওয়ে। হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ-দুর্নীতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলা রেলওয়েকে কালো বিড়ালদের হাত থেকে বাঁচাতে তৈরী হতে হবে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে। যারা দেশকে ভালোবাসেন, নিবেদিত থাকবেন তারা সেভ দ্য রোড-এর সাথে নির্লোভভাবে। যেভাবে আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক শুভংকর দেবনাথ, সোনাগাজী উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম, শান্তা ফারজানা সহ হাজার হাজার নিরাপদ ৪ পথ-এর আন্দোলক- পথসৈনিকগণ। তাদেরকে বলবো- বাংলাদেশের ৪ পথকে নিরাপদের জন্য এগিয়ে যেতে হবে বিন¤্র ভালোবাসায়-আলোআশায়...
মোমিন মেহেদী : চেয়ারম্যান, নতুনধারা বাংলাদেশ এনডিবি ও প্রতিষ্ঠাতা, সেভ দ্য রোড