সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর এসেছে সারাদেশে এসএসসির ফল প্রকাশের পর ফলাফল খারাপ হওয়ায় পঞ্চগড়, রংপুর, যশোর, শরীয়তপুর,ঠাকুরগাঁও ও টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় ২৭ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার চেষ্টা চালিয়েছে। এদের মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। এভাবে আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টা আমাদের সমাজের সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। এর প্রতিকারের ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা না হলে এটি মহামারি আকার ধারণ করে সামাজিক ভারসাম্যেও বিঘœ ঘটাতে পারে। আত্মহত্যার এই প্রবণতার কারণ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে জরুরী ভিত্তিতে। এটা রোধে অভিভাবক, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব, পারিপার্শ্বিক সবাইকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। পরীক্ষায় ফেল করার পর অভিভাবকদের সন্তানদের বকাঝকা না করে স্নেহের দৃষ্টি বোঝাতে হবে যা হয়েছে ভালো হয়েছে এমন মানসিকতা তৈরী করতে হবে। আগামীতে ভালোভাবে লেখাপড়া করে ফলাফল ভালো করতে হবে এমন বিশ্বাস ওদের ভিতরে জন্ম দিতে হবে। শিক্ষকদের অনুরুপ দৃষ্টি রাখতে হবে। সহপাঠিদের ব্যঙ্গ করা চলবে না তাদের উপহাস করা চলবে না ইত্যাদি। পারিপাশ্বিক এসব দিক লক্ষ্য না রাখলে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তখন পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
আত্মহত্যা কি?
আত্মহত্যা বা আত্মহনন হচ্ছে একজন নর কিংবা নারী কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়া বিশেষ সম্পন্ন করা। ল্যাটিন ভাষায় সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। যখন কেউ আত্মহত্যা করেন, তখন জনগণ এ প্রক্রিয়াকে আত্মহত্যা করেছে বলে প্রচার করে। ডাক্তার বা চিকিৎসকগণ আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতোমধ্যেই বিশ্বের অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরনের অপরাধ রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আত্মহত্যার আগে বিষয়টি ভাবা সকলের উচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-এর মতে প্রতি বছর সারা বিশ্বে প্রায় দশ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। যে সব কারণে মানুষের মৃত্যু ঘটে তার মধ্যে আত্মহত্যা ত্রয়োদশতম প্রধান কারণ। কিশোর-কিশোরী আর যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের নিচে তাদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।
আত্মহত্যা সমর্থন যোগ্য নয়
কোন ধর্ম কিংবা সচেতন প্রতিষ্ঠান আত্মহত্যাকে সমর্থন করতে পারে না। ইসলাম ধর্ম আত্মহত্যার বিরুদ্ধে। কোরআন শরিফে বলা হয়েছে "নিজেকে খুন করো না বা ধ্বংস করো না”। হাদিসে উল্লেখ আছে আত্মহত্যা করা বেআইনি এবং মহাপাপ। হিন্দুধর্মে আত্মহত্যাকে ঘৃণা করা হয় এবং সমসাময়িক হিন্দু সমাজে আত্মহত্যাকে অন্যকে হত্যা করার সমান পাপ বলে মনে করা হয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্র বলে যে যারা আত্মহত্যা দ্বারা মারা যায় এমন ব্যক্তির আত্মা জগতের অংশ হয়ে যাবে, পৃথিবীর ভেতরে ঘুরতে থাকবে যতক্ষণ না অন্য কেউ মারা যায় বা তার নিজের জীবন গ্রহণ করে। খ্রিস্টধর্মের বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মহত্যা একটি পাপ বলে মনে করা হয়। মূলত মধ্যযুগের প্রভাবশালী খ্রিস্টান চিন্তাবিদদের রচনাগুলো যেমন সেন্ট অগাস্টিন এবং সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের মতে আত্মহত্যা পাপ বলে বিবেচিত না হলেও ক্যাথলিক মতবাদে বলা হয়েছে "তুমি নিজেকে হত্যা করোনা"। সেইসাথে ধারণা করা হয় যে জীবন ঈশ্বরের দ্বারা প্রদত্ত একটি উপহার যা নষ্ট হওয়ার নয়। ইহুদীবাদও এই জীবনকে মূল্যবান বলে মনে করে এবং আত্মহত্যাকে ঈশ্বরের ধর্মকে অস্বীকার করার সমতুল্য বলে মনে করা হয়। এক সময় আত্মহত্যাকে ইউরোপে একটি পাপ হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল এবং এটিকে শয়তানের কাজ হিসেবে নিন্দা করা হতো। ফ্রান্সের লুই চতুর্দশ ১৬৭০ সালে জারি করা ফৌজদারি অধ্যাদেশ অনুযায়ি মৃত ব্যক্তির শরীরটি রাস্তায় টেনে আনা হত, মাথা নিচু করে তারপর আবর্জনা দিয়ে আবৃত করা হত। উপরন্তু, ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি জব্দ করা হত। প্রাচীন এথেন্সে যদি কোন ব্যক্তি রাষ্ট্রের অনুমোদন ব্যতিরেকে আত্মহত্যা করত তাহলে তাকে সাধারণ কবরস্থানের সম্মান দেয়াকে অস্বীকার করা হত। তাকে কবরস্থ করা হত শহরের বাইরে অবস্থিত কোন জায়গায়। শুধু তাই নয় তার জন্য কোন স্মৃতিফলক ব্যবহার করতে দেয়া হত না। তবে সামরিক পরাজয়ের মোকাবেলা করার জন্য এটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি বলে মনে করা হতো। প্রাচীন রোমে আত্মহত্যা প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত ছিল,পরে এটি অর্থনৈতিক খরচের কারণে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি অপরাধ বলে অভিহিত হয়েছিল। তবে এখন বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশগুলোতে আত্মহত্যা আর অপরাধ নয়। মধ্যযুগ থেকে বেশিরভাগ পশ্চিমা ইউরোপীয় দেশ গুলোতে ১৮০০ সাল পর্যন্ত এটি অপরাধ ছিল। বর্তমানে অধিকাংশ মুসলমান-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে এটি একটি অপরাধ।
কেন আত্মহত্যা ?
মানুষ কেন আত্মহত্যা করে এ প্রসঙ্গ এলে অনেক কথা উঠে আসে। বলা চলে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাই আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়ায়। যেমন-হতাশা, জীবনের আনন্দ হারিয়ে ফেলা, বিষ্ণতা ,উদ্বিগ্নতা, সমস্যা সমাধান করার ক্ষমতা কমে যাওয়া, ক্ষমতা হৃাস পাওয়া যা আগে ছিল, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা,প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নিজেকে অন্যদের বোঝা মনে হওয়া। এছাড়া অনেকে মনে করেন যে সে সমাজের অংশ নয়। এসব আত্মহত্যা মূলত অহংকারী আত্মহত্যা বলে পরিচিত। পরিবারের সদস্য বা বন্ধুকে হারানো,চাকরির ক্ষতি বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (যেমন একা বেঁচে থাকা) আত্মহত্যার ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে। গবেষকদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার উঠে এসেছে এসব মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে ৮৭ শতাংশ থেকে ৯৮শতাংশ আত্মহত্যা সংঘটিত হয়। এছাড়াও আত্মহত্যাজনিত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে নেশায় আসক্তি, জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে না পাওয়া ইত্যাদিও রয়েছে। আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব, দারিদ্র্যতা, গৃহহীনতা এবং বৈষম্যজনিত উপাদানগুলো আত্মহত্যায় উৎসাহিত করে থাকে বলে মনো বিজ্ঞানিরা মনে করেন। দারিদ্র্যতা সরাসরি আত্মহত্যার সাথে জড়িত নয়। কিন্তু এটি বৃদ্ধির ফলে আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে বলে মনে করা হয়। উদ্বেগজনিত কারণে আত্মহত্যার উচ্চস্তরে ব্যক্তি অবস্থান করে। শৈশবকালীন শারীরিক ইতিহাস কিংবা যৌন অত্যাচার, অথবা, কঠোর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সময় অতিবাহিতজনিত কারণও আত্মহত্যার ঝুঁকিগত উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচেছ। বর্তমানে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়েছে। পরিবার বা সমাজ স্বীকৃতি না দেয়ায় প্রেমিক যুগলের সম্মিলিত আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে এদেশে। ডিজিটালাইজেসনের কারণেও আত্মহত্যা ঘটছে। অনেক সময় ইন্টারনেট আত্মহত্যার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইন্টারনেটের নানাবিধ অপ-ব্যবহারের কারণেও আত্মহত্যার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া আরো নানাবিধ কারণ থাকতে পারে আত্মহত্যার। তবে যে কারণগুলো উল্লেখ করা হলো তা মানব সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এসব কারণে ভেঙ্গে না পরে জীবনকে জীবনের মত চলার অধিকার দিতে হবে আত্মহত্যায় উদ্যোগি ব্যক্তিকে। সামাজিক ভারসাম্যহীনতার কারণে যে সব আত্মহত্যা ঘটছে এর জন্য সমাজপতিদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ যারা আত্মহত্যা করে তারা আত্মহত্যার কারণটি নিজের জীবনের জন্য যুক্তিযুক্ত বলে মনে করে। কিন্তু সমাজ এটিকে যুক্তিযুক্ত মনে করে না।
আত্মহত্যা মানসিক ব্যধি
এক পরিসংখ্যানে পাওয়া গেছে, প্রায় ২৭ শতাংশ থেকে ৯০ শতাংশের বেশি সময় আত্মহত্যার সাথে মানসিক অসুখের সম্পর্ক থাকে । এশিয়াতে মানসিক রোগের হার পশ্চিমা দেশের চেয়ে অনেক কম। প্রায় ৮০ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন যারা মৃত্যুর আগে এক বছরের মধ্যে ডাক্তার দেখিয়েছেন এবং যারা আগের মাসে ডাক্তার দেখিয়েছেন তাদের প্রায় ৪৫ শতাংশ আত্মহত্যা করেছেন। যারা আত্মহত্যা করেছিলেন তাদের প্রায় ২৫-৪০ শতাংশ আগের বছর মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলির সাথে যোগাযোগ করেছিল। তবে ডাক্তারের কাছে না গিয়ে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে প্রচুর।
আত্মহত্যার ধরণ
যেমন- গলায় ফাঁস দিয়ে, বিষাক্ত কীটনাশক পান করে এবং আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে মানুষ আত্মহত্যা করে। ৫৬ টি দেশের মধ্যে একটি পর্যালোচনা উঠে এসেছে যে বেশিরভাগ দেশের মধ্যে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা হয়। যার মধ্যে ৫৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৯ শতাংশ মহিলা আত্মঘাতী ছিল। এছাড়া বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যার ৩০ শতাংশ কীটনাশক বিষক্রিয়া থেকে ঘটেছে। অনেক দেশে মাদকদ্রব্যের অপব্যবহারের মাধ্যমে আত্মহত্যা করে থাকে। মৃত্যুর হার পদ্ধতি অনুসারে আগ্নেয়াস্ত্র ৮০-৯০ শতাংশ, পানিতে ডুবে ৬৫-৮০ শতাংশ,গলায় ফাঁস দিয়ে ৬০-৮৫ শতাংশ, গাড়ি দুর্ঘটনায় ৪০- ৬০ শতাংশ , লাফিয়ে ৩৫-৬০ শতাংশ, ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ আগুনে পুড়ে, কীটনাশক পান করে ৬০ থেকে৭৫ শতাংশ ও ওষুধের মাত্রা বাড়িয়ে ১.৫-৪ শতাংশ মৃত্যুবরণ করেন।
বিশ্ব ব্যপি আত্মহত্যার হার পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আত্মহত্যার হার,আফ্রিকায় ০.৫ শতাংশ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া ১ দশমিক ৯ শতাংশ , আমেরিকা ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং ইউরোপ ১ দশমিক ৪ শতাংশ । প্রতি একলাখে আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি দক্ষিণ কোরিয়ায়। এ হার ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এর পরেই রয়েছে ভারত ২৩ দশমিক ২ শতাংশ। অস্ট্রেলিয়ায় ৮ দশমিক ৬, কানাডা ১১ দশমিক ১, চীন ১২ দশমিক ৭ , যুক্তরাজ্য ৭ দশমিক ৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। আত্মহত্যায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে নারীর তুলনায় পুরুষের প্রায় ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি।
রোধ করার কিছু উপায়
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে আত্মহত্যাকে মানসিক অসুস্থতাসংক্রান্ত বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করলেও উপযুক্ত চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে এ ব্যাধি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। যখন একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার বিষয়ে ব্যাপক চিন্তা-ভাবনা শুরু করেন, তখনই তাকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। মনোবিদগণ মনে করেন যখন ব্যক্তি নিজেকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তা জানামাত্রই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে কাউকে জানানো। আত্মহত্যা প্রতিরোধে যৌথ প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসক,পরিবার এবং ভুক্তভোগির সাথে মানসিক সমন্বয় সাধন করে আত্মহত্যা প্রবণতা রোধ করতে হবে।
বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার যে উপসর্গটি লক্ষ্য করা যাচ্ছে তা প্রতিরোধে সহমর্মিতা, ভালোবাসা, মায়া মমতা ইত্যদির মাত্রাকে বাড়িয়ে দিতে হবে।
প্রতিবছর ১০ সেপ্টেম্বও আন্তর্জাতিক আত্মঘাতী অভিযান এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালন করা হয়। এই দিবসটিকে সামনে রেখেও আত্মহত্যার কুফল সর্ম্পকে ব্যপক প্রচারণা চালাতে হবে। সম্প্রতি এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল খারাপের অজুহাতে অত্মহত্যার যে বিষবাস্প ছড়াচ্ছে তা অচিরেই নির্মূল না করলে এটি মহামারি আকারে রূপ নিতে পারে। তাই এ বিষয়ে প্রতিটি পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক সচেনতা জরুরী হয়ে পড়েছে।