দিন দিন কার্গো বাণিজ্য হারাচ্ছে বাংলাদেশ বিমান। রফতানিকারকরা বর্তমানে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিবর্তে বিকল্প রুটে দেশের বাইরে কার্গো পাঠাচ্ছে। এতে কমছে বিমানের ব্যবসা। মূলত অস্বাভাবিক হ্যান্ডলিং ও বেবিচক চার্জ আদায়ের পরও দ্রুত সেবা নিশ্চিত না হওয়ায় কলকাতা ও কলম্বো রুটে কার্গো চলে যাচ্ছে। আর এ বিষয়ে কোন ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়ায় দিন দিন সঙ্কুচিত হয়ে আসছে শুধু বিমানের কার্গো পরিধি। বর্তমান বিশ্বের তুলনায় বিমানের কার্গোতে প্রতি কেজিতে ১ ডলার বেশি চার্জ আদায় করা হচ্ছে। বার বার রফতানিকারকরা বিমান ও বেবিচকের কাছে হ্যান্ডলিং ও সিকিউরিটি চার্জ কমানোর প্রস্তাব দেয়ার পরও কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ফলে রফতানিকারকরা বাধ্য হয়েই শুধু খরচ ও সময় বাঁচাতে বিকল্প পথে দেশের বাইরে কার্গো পাঠাচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান এবং বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড এ্যাসোসিয়েশস সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আকাশ পথে কার্গোর পরিধি দিন দিন অস্বাভাবিক হাওে বাড়ছে। প্রতি বছর গড়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ হারে কার্গোর ভলিয়ম বাড়ছে। ঢাকা থেকে আকাশ পথে পণ্য পরিবহনে এমিরেটস, লুফথানসা, টার্কি, ক্যাথে প্যাসিফিক, চায়না ইস্টার্ন, হংকং এয়ার, কাতার, কুয়েত, ইতিহাদ ও ব্যাঙ্কক এয়ারের কার্গো ফ্লাইটগুলো রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে রয়েছে। মূলত বিমানের নিজস্ব কার্গো উড়োজাহাজ সার্ভিস না থাকায় বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো এই রমরমা বাণিজ্য করছে। তারপরও বিমান নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে যাত্রীর পাশাপাশি বেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কার্গোও বহন করছে। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো হাউসে প্রচুর সমস্যা বিদ্যমান। স্থানাভাবের কারণে কার্গো লোড-আনলোডে সময় লাগা, বিমানের কার্গো হ্যান্ডলিং চার্জ ও সিভিল এভিয়েশনের সিকিউরিটি ও অন্যান্য চার্জ এতো বেশি যে, তা বিশ্বের সর্বদ্বিতীয়। অথচ এই কার্গো কলকাতা দিয়ে পাঠানো হলে খরচ কমে আসে কেজি প্রতি এক থেকে দেড় ডলার।
সূত্র জানায়, হযরত শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আমদানি ও রফতানি কার্গো হাউস দিয়ে বছরে ৩ লক্ষাধিক টন কার্গো হ্যান্ডলিং করা হয়। শুধু চলতি অর্থবছরেই ৩ লাখ ৬০ হাজার ১৭১ টন কার্গো সেবা দিয়েছে বিমান। কার্গোর এই উর্ধমুখী প্রবণতা থাকলেও বিমানবন্দরে অবকাঠামোগত ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ছে না। বিশেষ করে রফতানি কার্গো হাউসের শেড এতোই ছোট যে, প্রায়ই সময়মতো দ্রুত কার্গো সেবা থেকে রফতানিকারকদের বঞ্চিত হতে হয়। প্রায়ই শেডের বাইরে খোলা আকাশের নিচে মালামাল রাখতে হয়। তাতে অনায়াসে চুরি ও হারানোর ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে কার্গো রফতানিতে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয় করা সম্ভব। ঢাকা থেকে কেজি প্রতি ২ ডলার ২০ সেন্টস চার্জ লাগে। একই মাল কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে পাঠালে খরচ হয় মাত্র দেড় ডলার।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকা থেকে কলকাতা ও কলম্বো হয়ে নতুন রুটে প্রতিমাসে কমপক্ষে গড়ে ২৫ শত টন গার্মেন্টস পণ্য রফতানি পাঠানো হয়। পিক সিজনে তা আরো বাড়ে। এখানকার কার্গোতে নানাবিধ সীমাবদ্ধতার দরুন বাধ্য হয়েই গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা নতুন রুটের দিকে ঝুঁকছে। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে জরুরি ভিত্তিতে বিমানের কার্গোর অবকাঠামোগত ও অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো জরুরি। গত বছর কার্গো হাউসে আর-এ ৩ এরিয়ার স্থানসঙ্কুলান না হওয়ায় ভারতের ওই নতুন রুট ব্যবহারের বিশেষ অনুমোদন দেয়া হয়। এরপর থেকেই রফতানিকারকরা ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা ও কলম্বো রুটের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন। বিমানের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ২ লাখ বর্গফুটের রফতানি কার্গো হাউসে আরএ-৩ এরিয়ায় (ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানের বিশেষ নিরাপদ এলাকা) বিশেষ বেষ্টনীতে মাত্র ৪১ হাজার বর্গফুট। আমদানি কার্গোতেও মাত্র দেড় লাখ বর্গফুটের স্পেস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে। সীমিত এলাকায় এতো বিশাল পরিমাণের কার্গো হ্যান্ডল করাটা খুবই কষ্টসাধ্য। এতো সীমাবদ্ধতার মাঝে বিমান চলতি অর্থবছরে শুধু কার্গো শাখার রাজস্ব আদায় করেছে প্রায় হাজার কোটি টাকা। বিমানের ডেডিক্যাটেড কার্গো ফ্লাইট না থাকলেও শুধু নিজস্ব উড়োজাহাজ দিয়ে চলতি বছর প্রায় ৩০ হাজার টন কার্গো বহন করেছে।
এদিকে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ড এ্যাসোসিয়েশন্স পরিচালক বখতিয়ার জানান, সাধারণত ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি কার্গো ফ্লাইটে কেজি প্রতি ২ থেকে সোয়া ২ ডলার লাগে। তাছাড়া দিতে হয় বিমানের হ্যান্ডলিং চার্জ বাবদ ৮ সেন্ট ও সিভিল এভিয়েশনের বিভিন্ন সিকিউরিটি চার্জ বাবদ কেজি প্রতি ৬ সেন্টস। আরো ৬ সেন্টস লাগে স্পীড মানি ও অন্যান্য চার্জবাবদ। অথচ কলকাতা বিমানবন্দরে টার্মিনাল হ্যান্ডলিং ও সিকিউরিটি চার্জ বাবদ মোট লাগে মাত্র ৪ সেন্টস। সে তুলনায় বলা চলে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ব্যয় বিশ্বের সর্বোচ্চ দ্বিতীয় ব্যয়বহুল। সেদিক থেকে হিসেব করলে ঢাকার পরিবর্তে কলকাতা বিমানবন্দর দিয়ে কার্গো পাঠালে মোট ব্যয়ের ২৫ ভাগ সাশ্রয় হয়।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিমান সচিব মহিবুল হক জানান, বিমানের কার্গো চার্জ কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। যেভাবে বলা হচ্ছে কার্গো কমছে তা ঠিক নয়। কিছু রফতানিকারক দ্রুত মালমাল পাঠানোর জন্য ঢাকার পাশাপাশি কলকাতা বিমানবন্দর ব্যবহার করছেন।