এক সময় বুড়িগঙ্গা নদীর পানি পান করা যেতো। এখন নেই বুড়িগঙ্গার পানির রং ‘আলকাতরা’র মতো হয়ে রয়েছে! চারদিকের বাতাসে দুর্গন্ধ। মৎস্য ও জলজপ্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন যেখানে প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা এর ওপরে থাকা প্রয়োজন। সেখানে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এর অর্থ, বুড়িগঙ্গায় কোনো জলজপ্রাণীর অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়। এ রকম নদীকে বলা হয় ‘মৃত নদী’। ট্যানারি, ডায়িং, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য পুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে মিশে এই দশা হয়েছে। গত রোববার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) ছাড়া বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরে থাকা শিল্পকারখানা ১ মাসের মধ্যে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। শুধু তাই নয়, তথ্যাদিসহ নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে আগামী ৮ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরকে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে বলা হয়েছে। তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণ পাশে কেরানীগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত ৫২টি কারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইটিপি নেই।
বুড়িগঙ্গা নদীর দুই তীরে থাকা শিল্পকারখানা এক মাসের মধ্যে বন্ধ করার হাইকোর্টের নির্দেশটি প্রশংসার যোগ্য। এই নির্দেশ বুড়িগঙ্গার পানিদূষণ রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে বলে আমরা মনে করি। কেননা, ৫২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশির ভাগই ডায়িং কারখানা, যেগুলোর বর্জ্য বুড়িগঙ্গাদূষণে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে আসছিল। অন্যদিকে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের মিথ্যা হলফনামা প্রদান ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা সত্যিই দুঃখজনক। এতোবড় পদে থেকেও এ রকম দায়ীত্বহীনতা গোটা দায়ীত্বশীলদের জন্যই লজ্জার। ওয়াসার কোনো পয়োনিষ্কাশন লাইন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য নিঃসরিত হয় না বলে গত জুনে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের প্রতিবেদন আকারে দেয়া হলফনামা সঠিক নয়। এ জন্য ‘নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা’ করে হাইকোর্টে আগের প্রতিবেদনটি উপস্থাপন না করার আরজি জানান ওয়াসার আইনজীবী।
হতাশাজনক বিষয়, ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ ব্যাপারে আদালতকে অসত্য তথ্য দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, বুড়িগঙ্গায় ওয়াসার কোনো সুয়ারেজ সংযোগ নেই। অথচ বিআইডব্লিউটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গায় ৬৮টি সুয়ারেজ সংযোগের মধ্যে ৫৬টি ওয়াসার। আদালত আদেশ অমান্য ও অসত্য তথ্য দেয়ায় কেন তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে না, সে বিষয়ে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন।
বুড়িগঙ্গা এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। মানববর্জ্যরে পাশাপাশি শিল্পবর্জ্য, ট্যানারিবর্জ্য, হাসপাতালের বর্জ্য, ইটভাটা, পলিথিন ইত্যাদির কারণে বুড়িগঙ্গা দূষিত বর্জ্যের আধারে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গা দূষণের কুফল হিসেবে পাশের এলাকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগ। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়, এ নদীর পানিদূষণ রোধে যাদের মূল ভূমিকা পালন করার কথা, তারা যখন মিথ্যা তথ্য দেন, তখন হতাশ হওয়া ছাড়া আর কি করার আছে!
আমরা আশা করব, নদ-নদী রক্ষা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো হাইকোর্টের নির্দেশ শতভাগ বাস্তবায়ন করবে। শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, দেশের অন্যান্য নদ-নদী, খাল-বিল রক্ষায়ও তারা সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে।