আজ ১২ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং বিভীষিকাময় দিনের শেষে ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাক হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে অতিষ্ট এ এলাকার গণমানুষ সম্মিলিতভাবে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মুক্তিযোদ্ধা ও গণমানুষ সম্মিলিতভাবে তীব্র প্রতিরোধে সম্মুখ যুদ্ধে মারখেয়ে পাক হানাদার বাহিনী ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে চুড়ান্ত আঘাত আসে ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে। সেদিন হিলি, গাইবান্ধা, বোনারপাড়া এবং মহিমাগঞ্জ থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রি-মুখী আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ভীত অন্যান্য পাকসেনারা তাদের পোষাক পরিবর্তন করে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। ফলে চূড়ান্ত বিজয়ের ৩ দিন আগেই স্বাধীনতা দেখতে পান এখানকার মুক্তিকামী মানুষ। সেই সঙ্গে উচ্ছাস আর আনন্দে ফেটে পড়েছিল গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সকল মুক্তিকামী মানুষ।
গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মক্তিযোদ্ধা বাবু শ্যামলেন্দু মোহন রায় জীবু জানান, ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গণহত্যার খবর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় এসে পৌঁছায়। তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য স্বাধীনতা পাগল জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুল মতিন তালুকদারের আহবানে সংগ্রাম কমিটি গোবিন্দগঞ্জের অদূরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের কাঁটাখালী সেতুটি ধ্বংস করে পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ ও যুদ্ধাস্ত্র বহনের যাত্রাপথ ধ্বংস করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২৬ মার্চ সারারাত চলে প্রস্তুতি। ২৭ মার্চ সকালে শত শত মুক্তিকামী তরুণ-যুবক, ছাত্র-জনতা হাতে হাতে কোদাল, শাবল, হাতুড়ি, খুন্তি ইত্যাদি নিয়ে দূর দুরান্ত থেকে ট্রাকযোগে আবার কেউ হেঁটে পৌঁছেন কাটাখালীতে সমবেত হন। সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং সেতুটি ধ্বংস করতে যার কাছে যা আছে তাই নিয়ে শুরু করে কাঁটাখালী সেতু ভাঙার কাজ।
এরপর সবার অক্লান্ত পরিশ্রমে ব্রীজের উত্তর পাশে কিছু অংশ ভাঙ্গা হলে হঠাৎ করে রংপুরের দিক থেকে পাক বাহিনীর একটি কনভয় ছুটে আসে ব্রীজের কাছে। কনভয়টি পৌঁছেই এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে থাকে মুক্তিপাগল বাঙ্গালীর ওপর। এ সময় নিরস্ত্র বাঙ্গালী জনতা প্রাণভয়ে ছুটে পালাতে গেলে হানাদারের এলোপাতাড়ি গুলির আঘাতে শহীদ হন আব্দুল মান্নান আকন্দ, বাবলু মোহন্ত, বাবু দত্তসহ অজ্ঞাত পরিচয় এক কিশোর ও এক বৃদ্ধ।
তখন থেকে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১১ ডিসেম্বর ভোর রাতে হিলি, গাইবান্ধা, বোনারপাড়া ও মহিমাগঞ্জ এবং গোবিন্দগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের ত্রি-মুখী আক্রমণে প্রায় দুই শতাধিক পাকসেনা নিহত হয়। এ সময় প্রাণভয়ে ইউনিফর্ম খুলে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পড়ে পালিয়ে যায় অন্যান্য পাকসেনারা।
পরদিন ১২ ডিসেম্বর জয়বাংলা স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে স্বাধীনতাকামী গণমানুষের বিপুল হর্ষধ্বনীর মধ্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও ছাত্র-জনতা গোবিন্দগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে সমবেত হয়ে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তালন করে। হানাদার মুক্ত হয় গোবিন্দগঞ্জ।
এদিকে ১২ ডিসেম্বর গোবিন্দগঞ্জ হানাদার মুক্ত দিবস উপলক্ষে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক সংগঠন দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।