চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অন্তত এক ডজন কাউন্সিলর এবার ফেঁসে যাচ্ছেন। চসিকের এসব কাউন্সিলররা যোগসাজশ করে রোহিঙ্গা নাগরিকদের জন্ম নিবন্ধন সনদ দিয়েছেন। এতে রোহিঙ্গাদের ভোটার হওয়ার পেছনে জড়িতদের চিহ্নিত করতে দুদকের টাস্কফোর্স গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম শহর চষে বেড়াচ্ছেন। কারাগারে আটক নির্বাচন কমিশন অফিসের কর্মচারীদের সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন দুদক টাস্কফোর্স। দুদক প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির ঘটনায় গঠিত টাস্কফোর্স এর আগে বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে গিয়েছেন। তারা চট্টগ্রাম মহানগরী, টেকনাফসহ বিভিন্ন স্থান ও দপ্তরে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যও নেবেন। ওই টাস্কফোর্সের তদন্তে ইতোমধ্যে অনেক বড় বড় রাঘববোয়ালের নামও এসেছে। এতে জনপ্রতিনিধি, নির্বাচন অফিসের বড় কর্মকর্তার নামও এসেছে রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির ঘটনায়। এই জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে কোটিপতি হওয়ার বিষয়টিও টাস্কফোর্সের তদন্তে সত্যতা মিলেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন অফিসের পাঁচ কর্মকর্তাকে নোটিশ দেয়া হয়েছে। দুইটি মামলাও হয়েছে। আরো মামলা হবে। যেখানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ডজন খানেক কাউন্সিলরের নামও রয়েছে।
একাধিক সূত্র জানায়, চলতি বছরের আগস্ট মাসে টেকনাফে রোহিঙ্গা ডাকাতের হাতে স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা নিহত হয়। পরে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে পুলিশের সাথে ক্রসফায়ারে রোহিঙ্গা ডাকাত নুর মোহাম্মদ ওরফে নুর আলম নিহত হয়। এসময় রোহিঙ্গা ডাকাত নুরুর কাছ থেকে উদ্ধার করা তার ভোটার স্মার্টকার্ড নিয়ে তোলপাড় শুরু হয় গোটা চট্টগ্রামে। পাশাপাশি বাঁশখালীতে লাকী আকতার নামের এক রোহিঙ্গা নারীর ভোটার হওয়ার বিষয়টি জানাজানি হলে নড়েচড়ে বসেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা। বিষয়টি তদন্তে কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তদন্ত টিমের সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক পর্যায়ে পুরো বিষয়টি ধোঁয়াশায় রাখেন। বিগত ২০০৮ সালে নিলামে বিক্রি করা নির্বাচন কমিশনের এনআইডি প্রকল্পের ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছিল। ওইসব ল্যাপটপ নিলাম হয়েছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তদন্ত দলের প্রধান খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে। নিলামের এই কম্পিউটার দিয়েই চট্টগ্রামে ২০১৮ সালে কমপক্ষে তিন হাজার রোহিঙ্গাকে ভোটার করেছেন নির্বাচন কমিশনের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এতে তারা কোটি কোটি অবৈধভাবে আয় করেছেন। এরমধ্যে জয়নাল, মোস্তফা ফারুক ও শাহনুর সিন্ডিকেট অন্যতম। নির্বাচন কমিশনের অফিসিয়াল সার্ভার ব্যবহার করে তারা দীর্ঘদিন ধরে জালিয়াতি চালিয়ে আসছিল।
সূত্র জানায়, দুদক গত ১৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসে অভিযান চালায়। ওইদিন দিবাগত রাতে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নালকে আটক করে নির্বাচন কমিশন। একইসাথে তার দুই সহযোগী সীমা দাশ ও বিজয় দাশকেও আটক করে। তাদের কাছ থেকে এনআইডি প্রকল্পের হারিয়ে যাওয়া একটি ল্যাপটপ উদ্ধার করে পুলিশ। আটক ৩ জনসহ ৫ জনকে আসামী করে চট্টগ্রাম নির্বাচন অফিস ১৬ সেপ্টেম্বর শহরের কোতোয়ালী থানায় মামলা করে। পরের দিন ওই মামলার তদন্ত ভার চলে যায় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের হাতে। এরপর থেকে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিটটি ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে। অন্যদিকে দুদক প্রাথমিক তদন্তে তিনটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদন দেয়া হয়। এরপর পরিচালক মো. জহিরুল ইসলামের নেতৃত্বে অধিকতর টাস্কফোর্স গঠন করে দুদক প্রধান কার্যালয়। টাস্কফোর্স অন্তত পৌনে তিন মাসের তদন্ত করে। তারা রোহিঙ্গা ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট জন্ম সনদ দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর। অনেক কাউন্সিলর জেনেশুনে, অনেকে না জেনে, আবার অনেকে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে রোহিঙ্গাদের জন্মসনদ দিয়েছেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে আসে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের গ্রেপ্তার হওয়া কর্মকর্তা- কর্মচারীরা রোহিঙ্গা ভোটার জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের বিষয়টিও দুদকের তদন্তে বেরিয়ে আসে।
এনিয়ে মানি লন্ডারিং, সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামে দুইটি মামলাও করেছে দুদক। গত ১৩ডিসেম্বর চসিকের ৩৪নং পাথরঘাটা ওয়ার্ড ও ৩৯নং দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। এসময় রোহিঙ্গাদের অনলাইন জন্মসনদ প্রদানের বিষয়ে সত্যতা পান দুদক টিম। ৩৯নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন দুদকের অভিযানের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমার পূর্বের কাউন্সিলর অনেককে বালাম খাতায় লিখে জন্মসনদ দিয়েছিলেন। আমরা ওই বালাম অনুসারে অনলাইন জন্মসনদ দিয়েছি। এমনিতে বাবা-মায়ের আইডি কার্ড দেখেই আমরা জন্মসনদ দিয়ে থাকি। তবে নাগরিকদের অভিযোগ- শুধু ভোটার আইডিই নয়; বিভিন্ন ঘটনায়ও একাধিক কাউন্সিলর অবৈধ পন্থায় কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। কাউন্সিলরদের দুর্নীতি বিষয়ে সঠিক তদন্ত হলে যা বেরিয়ে আসবে।