ছিমছাম ঘরটা শূন্য। কোনো আসবাবপত্র নেই। একটা দরজা এবং দু’পাশে দুটো জানালা আছে, ও দুটোও বন্ধ। তবে বাইওে সূর্য যে আলোর মেলা বসিয়েছে, সে আলোর কিছুটা এসে পড়ছে ফাঁক ফোঁকর গলে গলে। তাতে স্পস্ট ধবধবে সাদা মেঝে। দেয়াল ও সিলিংয়ের রঙও সাদা। কোথাও কোনো ফ্যান বা বাল্ভ নেই। অথচ ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা দেখা যাচ্ছে। চোখে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। না শীত না গরম। এ এক ভিন্ন পরিবেশ। ঘরময় আমার কথার প্রতিধ্বনি হচ্ছে-
আমি এখানে কেন, কেউ আছো?
আমার ভয় বেড়ে গেল প্রতিধ্বনি শুনে। একেতো শূন্য ঘর, তার ওপর মনে হচ্ছে আমার চারপাশে যেন অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। আশপাশে মানুষ থাকলে যেমন অনুভূত হয় ঠিক তেমন হচ্ছে।
ভয়ে আমার শরীর ভার হয়ে যাচ্ছে। জিহ্বা যেন দাঁতের কারাগারে অসুস্থ বন্দী। পড়ে আছে এক পাশে কাত হয়ে। অনেক কষ্টে ওকে সুস্থ করে বললাম,
তোমাদের দেখা যাচ্ছে না কেন? চুপ করে আছো কেন? কথা বল?
আবারো প্রতিধ্বনি। সহ্য করতে না পেরে দুই হাতের দুই আঙুল দুই কানে পুরে মাথার ভেতর চিহিহিহি শব্দ শুনতে লাগলাম।
সর্বশেষ প্রতিধ্বনি বদ্ধ এই ঘরটার দ্রাঘিমাংশে মিলিয়ে যাবার পর কান থেকে হাত সরিয়ে বললাম, ‘আমার কিন্তু ভয় করছে। তোমরা যদি কথা না বল, দেখা না দাও তা হলে আমি জ্ঞান হারাবো কিন্তু। অলরেডি আমার মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ শুরু হয়ে গেছে।’
সাথে সাথে দুই জানালা আর দরজা খুলে গেল। আমার কথার প্রতিধ্বনি হল খুব আস্তে।
আমার সম্মুখে ছিল দরজা। দৃষ্টি প্রসারিত করলাম ঐদিকে। দৃষ্টিশক্তি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হলো না। অসীম শূন্যতায় তাকিয়ে থেকে আমার চোখ ব্যথা করে উঠলো। বন্ধ করলাম এক মুহূর্ত চোখ। দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে মনে জাগলো। শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছি। চোখ খুললাম। তাকালাম ডানের জানালায়। অসাধারণ সুন্দর একটা পরিবেশ, আমাকে ক্রমশ কাছে টানছে মনে হচ্ছিলো।
এমন সময় একটা হাত দেখতে পেলাম জানালায় সুঠাম সে হাত। পাঞ্জার পাশেই সুন্দর করে ঝোলানো গোল্ডেন রঙের ঘড়ি। ইচ্ছে করছিলো সময়টা জেনে নিতে। কিন্তু না, ভয়ে আর সেই কাজটি করার সাহস এল না।
হঠাৎ আমার তিন হাত সামনে একজন মানুষ দৃশ্যমান হলো। ভয়ে আমার অবস্থা ত্রাহি ত্রাহি।
নিজের মনকে সাহস দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম আমি। কণ্ঠে এসে আটকে গেল কথাটা।
আবারো নিরবতা পালন করলাম। যদিও আমি প্রচণ্ড রকম বাচাল। আমরা বন্ধুরা আমাকে বরাবরই এড়িয়ে চলে বেশি কথা বলার জন্য। অথচ এখন ভয়ের কারণে আমার মুখও বন্ধ হয়ে আছে।
অনুসন্ধিৎসু চোখ আমার চেয়ে আছে বাইরের পরিবেশটার দিকে। চারপাশে সুন্দরের পসড়া সাজানো। নিরবতার রঙধনু দিয়ে কষ্টের কালোমেঘ দূর করতে চাইছি। কিন্তু না, সেই ভয় আমাকে নিস্তার দিলো না। হঠাৎ একটা ধমকে পুরো আৎকে উঠলাম-
এই মেয়ে ওঠার চেষ্টা করো।
উত্তরের কান্নাজড়িত কন্ঠে শুধু বললাম-
পা বাঁধা।
আমার পায়ের বাঁধন খুলে দেওয়া হলো। তবে বাইরে যাওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা রাখা হলো না। ততক্ষণে আমার প্রকৃতির ডাক এসেছে। একজন মানুষ হিসেবে আমার অধিকার প্রতিষ্ঠার শেষ চেষ্টা করতে সাহস সঞ্চয় করলাম এবং বিনয়ের ডানা মেলে বললাম-
আমার একটু টয়লেটে যেতে হবে; ব্যবস্থা আছে?
উত্তরে আবারো ধমকের সুর-
আগে আশপাশে তাকাও।
তাকালাম এবং যথারীতি অবাক হলাম এই ভেবে যে, এতটুকু ঘরের পাশে সুন্দর একটা টয়লেট আছে। তাতে বড় বড় করে লেখা ‘জলঘর’।
খুবই আশ্চর্য হচ্ছিলাম। কিন্তু ভয়ও ছিলো সাথে সাথে।
দুপুরের খাবার যখন দেওয়া হলো, তাতে ছিলো গরুর কালোভূনা মাংস আর রুটি। বুঝতে পারলাম আশপাশে কোথাও ঈদ পালন হচ্ছে। যে কারণে ঈদের এই মাংস চলে এসেছে। এই রুমটা কোথায় তা অনুমান করার জন্য বাইরে ভালোভাবে লক্ষ করলাম। যা দেখলাম তাতে কলিজা অনেক বড় হলেও ছোট হয়ে যাওয়া কথা। কমপক্ষে ১০ তলা বিল্ডিং-এর উপরে আছি। যেখান থেকে পালানোর আপাতত কোনো পথ নেই। যে কারণে আর ব্যর্থ চেষ্টা না করে খাওয়ার পরে বালিশহীন, বিছানাহীন ঘরটাতেই গা এলিয়ে দেই। রাতে যখন ঘুম ভাঙে তখন চারপাশে কালোর ছড়াছড়ি। পাশাপাশি তেলাপোকার মতো এলোমেলো গায় হাঁটছিলো কয়েকটি হাত। কোনো মতে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করতেই আবারো আমার হাত-পা বাঁধা হলো এবং...
শেষ দৃশ্য
অদৃশ্য আট-দশজন মানুষ এসে জড়ো হয়েছে ঘরে। আমার ধারণা তা হলে ঠিকই ছিল। নিজেকে আবারও বোঝালাম খুব করে। কিন্তু ভয়টা আমার থেকে যেতে চাচ্ছে না। শীতের কাঁথার মতো জড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে সাথে।
একটা সময়ের ভয়ের চাদরাবৃত্ত আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো কেবলই আমার অতিত। যেখানে আমার একান্ত প্রিয় মানুষ সোয়ান ছিলো, ছিলো সাফি। সাফি আমার একমাত্র সন্তান। সোয়ানের সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যুর পর। মায়ের কাছে সাফিকে রেখে এই রাস্তায় এসেছিলাম আমি। অনার্সে ভালো রেজাল্ট করার পরও কোনো চাকুরীর দিকে যেতে পারিনি। যেখানেই যাই শরীরের প্রতি বাড়তি চাহিদাটা থাকেই। তাই আর চাকরি নয় সরাসরি এই এখানেই চলে আসা। কিন্তু ওদের সাথে কথা ছিলো, একরাত। শুধু চাঁনরাতের কথা বলে ওরা আমাকে তিনটা দিন আটকে রেখে যেমন খুশি ব্যবহার করছে। আমার অবশ্য কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ভাবছি আমার ছেলেটার কথা, আমাকে ছাড়া কি ঈদ পালন করেছে। পাঠবইতে পড়েছিলাম ঈদ মানে খুশি। আসলে এই খুশি কাদের জন্য বড়ই জানতে ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে...