দেশের অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম গেইন করলেও তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির সিস্টেম লস ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। মূলত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে অবৈধ গ্যাস ব্যবহারের কারণেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের বেঁধে দেয়া সিস্টেম লসের চেয়েও কোম্পানিটি সাড়ে তিন ভাগ বেশি সিস্টেম লস করছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানিটি ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোয় গ্যাস বিরতণ করে। কিন্তু শিল্পঘন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে বিপুলসংখ্যক অবৈধ ব্যবহারকারীর কারণে কোনোভাবেই সিস্টেম লস কমানো যাচ্ছে না। খোদ রাজধানীতে অবৈধ ব্যবহারকারী থাকলেও তিতাস তা নির্মূল করতে পারছে না। তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জ্বালানি বিভাগ থেকে বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির শুরুতেই তিতাসকে চিঠি দিয়ে অবৈধ ব্যবহারকারী শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু এখনো কোম্পানিটির যে হারে সিস্টেমলস হচ্ছে, তাতে স্পষ্ট অবৈধ ব্যবহারকারী কমাতে পারেনি তিতাস। আবাসিক-বাণিজ্যিকের পাশাপাশি শিল্পমালিকরাও অবৈধ গ্যাস ব্যবহার করছে। যদিও তিতাস বলছে অবৈধ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তাদের লাইন কেটে দেয়ার পাশাপাশি জরিমানাও করা হচ্ছে। কিন্তু তাতেও কমছে না অবৈধ ব্যবহারকারীর সংখ্যা।
সূত্র জানায়, তিতাস থেকে পেট্রোবাংলার কাছে পাঠানো এক বছর মেয়াদি হিসাবনুযায়ী গত বছর জুন পর্যন্ত ১২ মাসের মধ্যে মাত্র দুই মাসে তিতাস সিস্টেম গেইন করেছে। বাকি ১০ মাসেই তিতাস সিস্টেম লস করেছে। কিন্তু বাস্তবে তিতাসের সিস্টেম গেইন হওয়ার কথাই সবচেয়ে বেশি। একটি বিতরণ কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে যে পরিমাণ গ্যাস কেনে, ওই পরিমাণের কম বিল আদায় করতে সমর্থ হলে তাকে সিস্টেম লস বলে। আর যদি কেনার চেয়ে বিক্রি বেশি হয় তাহলে সিস্টেম গেইন হয়। আবাসিক গ্যাস ব্যবহারকারীদের ৮৮ ঘনমিটার মাসিক ব্যবহার ধরে গ্যাসের বিল নেয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এর অর্ধেক গ্যাস ব্যবহার করে একটি আবাসিক সংযোগ। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিপুল গ্যাস বেঁচে যায়। যা বিতরণ কোম্পানির লাভ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিতরণ কোম্পানিগুলো সিস্টেম গেইনের সুফল মূলত আবাসিক গ্রাহকদের কাছ থেকে পেয়ে থাকে। কিন্তু অতিরিক্ত ওই গ্যাস বিক্রিতে বিতরণ কোম্পানির বাড়তি আয়ের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। বরং লোকসান দেখানো হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, তিতাসের এক বছরের হিসাবনুযায়ী ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সিস্টেম লস ছিল ৪ দশমিক ২৪ ভাগ। অবশ্য আগস্টে গিয়ে আবার ১০ দশমিক ৬৬ ভাগ সিস্টেম গেইন হয়। সেপ্টেম্বরে আবার সিস্টেম লস হয়েছে দশমিক ৫৮ ভাগ। পর্যায়ক্রমে সিস্টেম লস বেড়েছে গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। তিতাসের মতে, ওই বছর অক্টোবরে সিস্টেম লস ছিল ৫ দশমিক ৭৯ ভাগ, নবেম্বরে ছিল এক দশমিক ১০ ভাগ, ডিসেম্বরে ৯ দশমিক ৯৭ ভাগ, আর গত জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ যা ছিল ১৪ দশমিক ৯৭ ভাগ। গত ফেব্রুয়ারিতে কোম্পানিটির আবার সিস্টেম গেইন হয়েছে। তিতাসের হিসেবে দুই দশমিক ৪২ ভাগ সিস্টেম গেইন ছিল। যথাক্রমে গত জুন পর্যন্ত মার্চে ১৩ দশমিক ৫৯, এপ্রিলে ১১ দশমিক ৯৯, মে’তে ৯ দশমিক ৩৭ ও জুনে এক দশমকি ৪১ ভাগ সিস্টেম লস হয়েছে। আর অর্থবছরের গড় সিস্টেম লস ছিল ৫ দশমিক ৪৮ ভাগ। যদিও বিইআরসি সিস্টেমলস সর্বোচ্চ ২ ভাগ বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু তিতাস তার মধ্যে থাকতে পারেনি। তবে অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে সবচেয়ে থেকে বেশি সিস্টেম গেইন করেছে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। কোম্পানিটির গত অর্থবছরের হিসাবনুযায়ী ২৫ দশমিক ২০ ভাগ সিস্টেম গেইন করেছে। তারমধ্যে গত জুনে তারা সর্বোচ্চ ৪১ দশমিক ৩২ ভাগ সিস্টেম গেইন করেছে। ’১৮ সালের জুলাইয়ে ২৬ দশমিক ৫২, সেপ্টেম্বরে ২৭ দশমিক ৭৬, অক্টোবরে ২৭ দশমিক ২৩, নবেম্বরে ২৫ দশমিক ৬৩ ও ডিসেম্বরে ২৪ দশমিক ২৭ ভাগ। আর গত জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত যথাক্রমে ১৭ দশমিক ১৩, ২৩ দশমিক ২৬, ২৫ দশমিক ৫৮, ২১ দশমিক ৬৫, ২১ দশমিক ৭৩ ও ২১ দশমকি ৫০ ভাগ সিস্টেম গেইন করেছে। কোম্পানিটি দেশের উত্তরাঞ্চলে গ্যাস বিতরণ করে।
এদিকে সিলেটে গ্যাস বিতরণ কোম্পানি জালালাবাদ পরিমাণে কম হলেও গত অর্থবছরের একটি ছাড়া সব মাসেই সিস্টেম গেইন করেছে। তার মধ্যে ’১৮ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫৮, ৪ দশমিক ৫৪, ৬ দশমিক ৬৩, ২ দশমিক ৫২, ৫ দশমিক ৭৮ ভাগ ও এক দশমিক ৩৩ ভাগ। গত বছরের জানুয়ারি মাসে আবার কোম্পানিটি দুই দশমিক ১৯ ভাগ সিস্টেম লস করেছে। আর ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সিস্টেম গেনের ধারা অব্যাহত ছিল। তার মধ্যে ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ৬১, মার্চে তিন দশমকি ৭৪, এপ্রিলে ৭ দশমিক ৩৭, মে মাসে ৩ দশমিক ৭৩ আর জুনে ছিল ১৬ দশমিক ৩২ ভাগ। বছরের গড় সিস্টেম গেন ছিল ৫ দশমিক ২৩ ভাগ। আর কর্ণফুলীতে বছরের তিন মাস ছাড়া বাকি সময় ছিল সিস্টেম গেইন। চট্টগ্রাম এলাকায় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিটিও বছরে গড় সিস্টেম গেইন দেখায় দুই দশমিক ৩ ভাগ। ২০১৮ সালের কোম্পানিটির ডিসেম্বরে ২ দশমিক ৬৩ ভাগ সিস্টেম লস ছিল। তাছাড়া ওই বছরের জুলাই থেকে নবেম্বর পর্যন্ত সিস্টেম গেইন হয়েছে। বছরের জুলাইয়ে ১০ দশমিক ৬৬, আগস্টে ৭ দশমিক ৩০, সেপ্টেম্বরে ৬ দশমিক ৬৫, অক্টোবরে ৯ দশমিক ৩৯ ভাগ সিস্টেম গেইন হয়েছে। তবে গতবছর জানুয়ারিতে ৩ দশমিক ৭৩, মার্চে ৬ দশমিক ৪ ও মে মাসে ১০ দশমিক ৫৮ ভাগ সিস্টেম লস করেছে। তাছাড়া অর্থবছরের বাকি মাসগুলোয় ৫ থেকে ৮ ভাগের মতো সিস্টেম গেইন করেছে।
অন্যদিকে তিতাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, সরকার গৃহস্থালিতে সংযোগ বন্ধ করে দেয়ার পরও অনেকে নতুন বাসাবাড়ি নির্মাণের পর নিজে থেকে ঠিকাদার দিয়ে গ্যাসের লাইন লাগিয়ে নিয়েছে। পুরো ঢাকা শহর জুড়ে কোথায় কে অবৈধভাবে ব্যবহার করছে তা খুঁজে বের করা একটি জটিল বিষয়। এমনও দেখা যায় একটি বাড়িতে কিছু বৈধ ব্যবহারকারীর সঙ্গে অবৈধ ব্যবহারকারীও রয়েছে। একবার লাইন কেটে দিয়ে আসার পর আবারো কেউ কেউ অবৈধ লাইন প্রতিস্থাপন করে নিচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী পদক্ষেপ না নিলে গ্যাসের অবৈধ ব্যবহার বন্ধ হবে না।