যে খবর আমরা লিখতে চাই না, ছাপাতে চাই না। আমরা না চাইলেও বারবার লিখতে হয় ছাপাতেও হয়। তা হলো ধর্ষণ। মানসিক বিকৃতির চূড়ান্ত উদাহরণ ধর্ষণ। দেশে একের পর এক এ জঘন্য অপরাধ ঘটেই চলেছে। সমাজে কতিপয় বিকৃত মানসিকতার মানুষের এ জঘন্য অপরাধ করার প্রবণতা থেমে নেই। তাই সাধারণ মানুষের যে ক্ষোভ ধর্ষকদের বিরুদ্ধে, তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি মহান জাতীয় সংসদে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে। সংসদে বসে সংসদ সদস্যরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আমরা তাকে স্বাগত জানাই। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো সাংসদরা কঠোর পদক্ষেপের জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের সক্রিয়তার দাবি না জানিয়ে অসাংবিধানিক উপায় অবলম্বনের দাবি তুলে বলেছেন, “এই মুহূর্তে সমাজকে ধর্ষণমুক্ত করতে হলে ‘এনকাউন্টার মাস্ট’। ধর্ষককে গুলি করে মারতে হবে। একমাত্র ওষুধ পুলিশ ধরার পর ধর্ষককে গুলি করে মেরে ফেলা।” এটা সত্যিই অভাবনীয় ও বিস্ময়কর যে ধর্ষণ রোধ করার লক্ষ্যে ধর্ষককে ‘ক্রসফায়ারে হত্যা করার’ মতো নৈরাজ্যবাদী দাবি উত্থাপিত ও আলোচিত হয়েছে জাতীয় সংসদে। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় এই দাবি জানান জাতীয় পার্টির সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদ ও মুজিবুল হক। আরো আশ্চর্যজনক হলো, সরকার ও বিরোধীদলীয় একাধিক সাংসদ ওই দুই সাংসদের বক্তব্য সমর্থন করেন। সমাজ থেকে একটি অপরাধ নির্মূল করার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘ক্রসফায়ার’ বা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের মতো অনিয়মের পথ বেছে নেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কী?
জনপ্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে, সংবিধানে বিচার ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে কোনো বাহিনী বা কর্তৃপক্ষেরই বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের পথ অনুসরণের সুযোগ নেই। অপরাধ নির্মূলে কোনো অনৈতিক উপায় অবলম্বন কাম্য নয়। সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাংসদরা শুধু সংবিধান মেনে চলারই নয়, সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্র পরিচালনার অঙ্গীকার করেছেন। তারা কি কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারবেন, ধর্ষককে ক্রসফায়ারে হত্যা করলেই সমাজে আর একটিও ধর্ষণ ঘটবে না? তাৎক্ষণিকভাবে যাকে ধর্ষক হিসেবে চিহ্নিত করা হবে তিনিই প্রকৃত অপরাধী?
সমাজকে সুস্থ রাখতে, সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে ধর্ষকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি জরুরি। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রচলিত আইনের প্রতি আস্থা রেখেই বলতে চাই, বর্তমানের আইন দিয়েই ধর্ষকের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ঘৃণিত অপরাধ কমাতে শাস্তির কঠোরতার চেয়েও বেশি প্রয়োজন শাস্তির নিশ্চয়তা।
অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার নারী অথবা তার পরিবার সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের শঙ্কা থেকে অপরাধীর অপরাধ গোপন রেখে থাকে। এর বাইরে যারা অভিযোগ দায়ের করতে এগিয়ে আসছেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব অপরাধের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা। যত বড় অপরাধীই হোক, তাকে বিচারবহির্ভূত উপায়ে হত্যা করা সভ্য সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা জাতীয় সংসদে এই ধরনের বক্তব্যকে রাজনীতিকদের সার্বিক ব্যর্থতারই প্রতিফলন মনে করি।