ব্যাপক ধর্মীয় উদ্দীপনা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে শুক্রবার বাদ ফজর মদিনা নিবাসী মাওলানা মুফতি ওসমানের আ’ম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব । টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিনে শুক্রবার অনুষ্ঠিত হয় দেশের বৃহত্তম জুমার জামাত। ইজতেমায় অংশগ্রহণকারী লাখ লাখ মুসল্লি ছাড়াও রাজধানীসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ এই বৃহত্তম জুমার জামাতে শরীক হন। শুক্রবার বিকেলে অনুকুল আবহাওয়া ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকায় ইজতেমায় আগত মুসল্লিগণ স্বাচ্ছন্দে তাবলীগ জামাতের শীর্ষমুরুব্বিদের বয়ান শুনছেন এবং ইবাদত বন্দেগীতে মশগুল রয়েছেন। শনিবার ইজতেমার দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল রোববার মধ্যাহ্নের পূর্বে যে কোনো একসময় আখেরী মোনাজাতের মধ্যদিয়ে সমাপ্তি ঘটবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব তথা এবারের ইজতেমার ৫৫তম আসর। সকাল থেকেই সর্বস্তরের মুসলমানরা জুমার জামাতে শামিল হওয়ার জন্য টুপি, পাঞ্জাবী পরে জায়নামাজ হাতে ইজতেমা মাঠের দিকে ছুটতে দেখা গেছে। দেশ বিদেশের লাখো মুসল্লি¬র সাথে একই জামাতে শরীক হয়ে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে বেশি সওয়াব হাসিলের উদ্দেশ্যে সকলের মধ্যে দেখা গেছে ব্যাকুলতা। জুমার জামাতে ইমামতি করেন বাংলাদেশের মাওলানা মোশাররফ হোসেন।
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দেশ-বিদেশ থেকে মুসল্লিদের টঙ্গী মুখি স্রোত অব্যাহত রয়েছে। বহুল কাঙ্খিত আখেরী মোনাজাত পর্যন্ত এ স্রোত আরো প্রবল হবে।
জুমার নামাজে ভিআইপিদের অংশগ্রহণ : বিশ্ব ইজতেমা মদয়ানে জুমার নামাজে ডেপুটি স্পীকার ফজলে রাব্বি মিয়া, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ.ক.ম মোজাম্মেল হক, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমীর মাওলানা মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন।
ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের প্রথম দিনে যারা বয়ান করলেন: ইজতেমা ময়দানের মিডিয়া সমন্বয়কারি মো. সায়েম জানান, বাদ ফজর মদিনা নিবাসী মাওলানা মুফতি ওসমানের আ’ম বয়ানের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব। তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করে মাওলানা আব্দুল্লাহ মনসুর। সকাল সাড়ে ৯টায় তালিমের বয়ান করেন ভারতের মাওলানা মুফতি আসাদুল্লাহ, তাঁর বয়ান বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুফতি ওসামা ইসলাম। জুমা নামাজের পূর্বে সালাতুত তাসবিহ নামাজের ফাজায়েল সম্পর্কে বয়ান করেন মাওলানা মুফতি ফয়জুর রহমান। বাদ জুমা বয়ান করেন দিল্লি নিজামুদ্দিন মারকাযের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা চেরাগ উদ্দিন, তাঁর বয়ান বাংলায় ভাষান্তর করেন বাংলাদেশের মাওলানা আশরাফ আলী। বাদ আসর বয়ান করেন বাংলাদেশের মাওলানা খান শাহাবুদ্দিন নাসিম। বাদ মাগরিব বয়ান করেন দিল্লির মাওলানা জামশেদ, তাঁর বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ। তবে মাওলানা চেরাগ উদ্দিন বাদ ফজর আ’ম বয়ান করার কথা থাকলেও শারীরিক সমস্যার কারণে মুরুব্বিদের মাশোহারার মাধ্যমে তাঁকে বাদ জুমা বয়ানের এজাজত দেয়া হয়।
বয়ানে যা বলা হলো : বাদ ফজর কালেমা, নামাজ, ইলম ও যিকির, ইকরামুল মুসলিমীন ও তাসহীহে নিয়ত নিয়ে বিস্তারিত বয়ান করা হয়। বয়ানে মদিনা নিবাসী মাওলানা মুফতি ওসমান বলেন, ইজতেমা ওয়ালাদের কাজ হলো পরিপূর্ণভাবে দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করা। নবী করিম (সা.) দাওয়াতের মেহনতের জন্য মদিনা মনোয়ারা ছেড়ে হিজরত করেছিলেন। তারপর আবার নিজ এলাকায় এসে দাওয়াতের কাজ জিন্দা করেছিলেন। নবী করিম (স.) যেভাবে মেহনতের মাধ্যমে দ্বীনকে জিন্দা করেছিলেন। আমরাও ইজতেমা থেকে শিক্ষা নিয়ে দ্বীনের কাজে বেরিয়ে যাবো, যাতে দ্বীনকে দুনিয়ার বুকে জিন্দা রাখা যায়।
তিনি আরও বলেন, দাওয়াতের মাধ্যমে ইমানওয়ালা জিন্দেগী, আমলওয়ালা জিন্দেগী ও সত্য ও সুন্দর জিন্দেগী তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, যারা সমাজে দাওয়াতের কাজ করবে দাওয়াত গ্রহণকারী যত নেক আমল করবেন তা থেকে ওই দাওয়াত দেয়া বান্দাও সমপরিমান সাওয়াব পাবেন। কাউকেই কম সাওয়াব দেয়া হবে না। দাওয়াতের কাজে জান ও মাল কুরবান করতে হবে। তিনি আল্লাহর বড়ত্ব তুলে ধরে বলেন, নবী করিম (স.) কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, হে কম্বল গায়ে দেনেওয়ালা, আপনি আল্লাহর বড়ত্বের গুনগান করুন। আল্লাহর বড়ত্বের কথা বলাই নবী-রাসুলদের কাজ। আমাদের কাজ। তিনি বলেন, আল্লাহ সর্বজ্ঞানী। আল্লাহ তায়াল সবকিছুর উপরে ক্ষমতা রাখেন। পুরো দুনিয়ায় কোথায় কি আছে, তা আল্লাহ তায়ালার নখদর্পণে। তিনি বলেন, আমরা তো ঢাকা শহরে কয়টি গাছ আছে তাও বলতে পারবো না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা অস্ট্রেলিয়ার জঙ্গলে কয়টি গাছ, আফ্রিকার জঙ্গলে কয়টি গাছ, পুরো দুনিয়ার জঙ্গলে কয়টি গাছ পশু-পাখি আছে তাও বলতে কোন কষ্টই হবে না।
তিনি আরও বলেন, দুনিয়ার জিন্দেগী অনিশ্চিত জিন্দেগী, অক্ষম জিন্দেগী। দুনিয়ার জিন্দেগী হলো ধোকার জিন্দেগী। আর হাকিকতে বা বাস্তবতার দিক দিয়ে আসল জিন্দেগী হলো আখেরাতের জিন্দেগী। আখেরাতের জিন্দেগী হলো চিরস্থায়ী জিন্দেগী। অবশ্যই প্রত্যেক মানুষকে আখেরাতের জিন্দেগীতে যেতে হবে। প্রত্যেক মানুষকে দুনিয়ার জিন্দেগী ছেড়ে যেতে হবে। এতে কোন রকমের সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের দুই চোখে যা কিছু দেখি আর না দেখি আল্লাহ ছাড়া সবই মাখলুক। আর মাখলুক কিছুই করতে পারে না আল্লাহর হুকুম ছাড়া। আল্লাহ সবকিছু করতে পারেন মাখলুক ছাড়া। তিনি বলেন, একমাত্র হুজুর (সা.) এর বাতানো তরিকায় দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি ও কামিয়াবী।
বয়ানের তাৎক্ষণিক অনুবাদ: বিশ্ব ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের ১০-১২জন শুরা সদস্য ও বুজর্গ বয়ান পেশ করছেন। মূল বয়ান উর্দূতে হলেও বাংলা, ইংরেজী, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাৎক্ষনিক অনুবাদ করা হচ্ছে। বিদেশী মেহমানরা মূল বয়ান মঞ্চের উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বপাশে হোগলা পাটিতে বসেন। বিভিন্ন ভাষাভাষীর মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান।
খাস বয়ান, খুসুশি বয়ান ও বধিরদের জন্য বয়ান : শুক্রবার সকালে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশ্যে খাস বয়ান করা হয়। বয়ান মঞ্চের সামনে উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকদের বিভিন্ন মেয়াদে চিল্লায় বের হওয়ার উপর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। ময়দানে স্থাপিত নামাজের মিম্বার থেকে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রদের উদ্দেশ্যে খুসুশি বয়ান পেশ করা হয় এবং ময়দানে আগত দেশের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীদের জন্য ময়দানের উত্তর পূর্ব পাশের টিনশেড মসজিদে খাওয়াজের বয়ান করা হয়।
এদিকে বিশ্ব ইজতেমায় আগত বধির (কানে শোনে না এমন) মুসল্লিদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় জামাতবদ্ধ করে বয়ান শোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদেরকে বিশেষ ব্যবস্থায় ইশারা ইঙ্গিতের মাধ্যমে বয়ান বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে।
ইজতেমা ময়দানে তিন মুসল্লির মৃত্যু : গত বুধ ও বৃহস্পতি দুই দিনে ইজতেমা ময়দানে তিনজন মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারা বাজার থানার চানপুর লক্ষ্মীপুর গ্রামের মৃত হযরত আলীর ছেলে কাজী আলাউদ্দিন (৬৫), নরসিংদী জেলার বেলাব থানার বিরবাঘরের চন্দনপুর গ্রামের মৃত: আব্দুর রহমানের ছেলে সুরুজ মিয়া (৬০) ও গাইবান্ধা জেলার ফুলছরি থানার টেংরাকান্দি গ্রামের রমজান আলীর ছেলে গোলজার হোসেন (৪০)।
টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা : শুক্রবার দুপুর ৩টা পর্যন্ত ঠান্ডাজনিত কারণে প্রায় দুই শতাধিক মুসল্লি টঙ্গী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এছাড়াও ইজতেমাস্থলের পার্শ্ববর্তী মুন্নু কটন মিলস প্রাঙ্গণে টঙ্গী ঔষধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি, হামদর্দ (ল্যাবরেটরিজ) লি:, যমুনা ব্যাংক ফাউন্ডেশন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম, র্যাব, ইবনে সিনাসহ ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে হাজার হাজার মুসল্লি বিনামূল্যে বিভিন্ন রোগের ওষুধ সংগ্রহ ও প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছে।
ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পগুলোতে মাথা ব্যাথা, সর্দি কাঁশি, চুলকানি ও দুর্বলতা নিয়ে আসেন পঞ্চগড় জেলার বোদা থানার বোয়ালমারি গ্রামের নূর মোহাম্মদ (৬০)। তিনি বলেন, কয়েকদিন যাবত সর্দি কাশি ও মাথা ব্যথায় ভোগছি। এছাড়াও শরীর দুর্বল লাগে। ঢাকার কেরানিগঞ্জের বশির উদ্দিন (৪৫) মাথা ব্যথা ও জ্বরের ওষুধ নিতে ময়দানে স্থাপিত ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে এসেছেন।
বিদেশি মুসল্লিদের অংশগ্রহণ: শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত বিশ্বের ৩১টি দেশের ১ হাজার ৪৪১জন বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানের বিভিন্ন তাবুতে অবস্থান নিয়েছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য জানিয়েছেন। তবে আয়োজক কমিটির দাবি ময়দানে ৩ হাজারের উপরে বিদেশি মেহমান অবস্থান নিয়েছেন। আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত বিদেশি মেহমানের আগমন অব্যাহত থাকবে।
এব্যাপারে বিশ্ব ইজতেমার জিম্মাদার প্রকৌশলী শাহ মো. মুহিবুল্লাহ বলেন, ময়দানের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। কোথাও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ময়দানে আগত মুসল্লিরা তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল রয়েছেন। আগামী রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা।