আবারো সঙ্কটের মুখে দেশের লবণ শিল্প। একটি সিন্ডিকেট সোডিয়াম সালফেটের নামে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে বিদেশ থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি করছে। পাশাপাশি শিল্পে ব্যবহৃত লবণের নামে বাণিজ্যিক আমদানিতেও অবৈধ সুযোগ করে নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে মাঠপর্যায়ের প্রান্তিক চাষী, পরিশোধনকারী ও বাণিজ্যিকীকরণে সংশ্লিষ্ট লবণ মিলাররা সঙ্কটের মুখে পড়েছে। তাতে বাজারজাতকরণে মার খাচ্ছে দেশীয় উৎপাদিন লবণ। এমন পরিস্থিতিতে লবণের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবিতে লবণ চাষী, লবণ ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও লবণ মাঠ মালিকদের সমন্বয়ে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারী কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত না হলে বৃহত্তর আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বিসিক এবং লবণ শিল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে লবণের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই দেশীয় উৎপাদন থেকে আসে। তবে বিভিন্ন সময়ে ঘাটতি মেটাতে মিল মালিকদের আমদানির সুযোগ দেয়া হতো। তবে বিগত ২০১৮ সাল থেকে তা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ রয়েছে। অথচ বিভিন্ন শিল্পে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের নামে যথেচ্ছাচারভাবে নিয়মিত আসছে মিথ্যা ঘোষণার সোডিয়াম সালফেটের (খাওয়ার অযোগ্য) নামে সোডিয়াম ক্লোরাইড (ফিনিশড লবণ)।
সূত্র জানায়, সোডিয়াম সালফেটের আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার মাত্র ২০ শতাংশ। অথচ সোডিয়াম ক্লোরাইডের এ হার (শুধু মিল মালিকদের মাধ্যমে আমদানিকৃত) ৯৩ শতাংশ। এ সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের (ঢাকাভিত্তিক) একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট মোটা অঙ্কের মুনাফা লাভে বিভিন্ন গার্মেন্টস, টেক্সটাইল এবং যেসব শিল্পের কাজে লবণ প্রয়োজন তাদের নামে সোডিয়াম সালফেট (ফিনিশড লবণ) আমদানি করছে। যা আমদানির পর সরাসরি প্যাকেটজাত হয়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ড নামে খোলা বাজারে চলে যাচ্ছে। দেশীয় লবণের তুলনায় আমদানি লবণের মূল্য অপেক্ষাকৃত বেশি হলেও ভোক্তাদের আমদানি লবণের প্রতি আগ্রহ বেশি। কেননা ওই লবণ দেখতে সাদা ধবধবে এবং আকারে অনেকটা মিহি, তার ওপর প্যাকেটজাত। সেক্ষেত্রে দেশীয় উৎপাদনের লবণ বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এর ফলে প্রান্তিক চাষীরা উৎপাদিত লবণের উচিত মূল্য পাচ্ছে না। পাশাপাশি মাঠপর্যায় থেকে উৎপাদিত লবণ ক্রাশিং কাজে জড়িত মিল মালিকরাও বাজার হারাচ্ছে। এ অবস্থায় তিন শতাধিক মিলের মধ্যে বেশিরভাগ বন্ধই থাকছে।
সূত্র আরো জানায়, বিসিকের হিসাব অনুযায়ী দেশে লবণের চাহিদা ১৮ লাখ টনেরও বেশি হলেও বেসরকারী পর্যায়ের হিসাব অনুযায়ী তা ২৪ থেকে ২৫ লাখ টন। ট্যারিফ কমিশনের হিসাব অনুযায়ী বিগত ১৮ সালে দেশে লবণ উৎপাদিত হয়েছে ১৬ লাখ টন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ লাখ টনে। সঙ্গত কারণে সংশ্লিষ্ট সকল মহলে প্রশ্ন উঠেছে, দেশীয় চাহিদা দেশীয় উৎপাদন দিয়ে মেটানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন খাবার লবণ বিদেশ থেকে মিথ্যা ঘোষণা এবং বাণিজ্যিক পর্যায়ে আমদানির সুযোগ দেয়া হচ্ছে। সেক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ফিনিশড লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) মিথ্যা ঘোষণায় শুল্ক ফাঁকি দিয়ে দেশে প্রবেশ করছে। এ সুযোগটি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত করছে সিন্ডিকেট সদস্যরা। আমদানির অধিকাংশ লবণ আসছে চীন ও ভারত থেকে এবং তা মিথ্যা ঘোষণায়, যাতে মোটা অঙ্কের রাজস্বও হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে মাঠপর্যায় থেকে মিল মালিকরা লবণ কিনে থাকে মণ হিসাবে। অনুরূপভাবে মিলে পরিশোধন করার পর এ লবণ বিক্রিও হয় মণ হিসাবে। বর্তমানে মাঠ পর্যায়ে কাঁচা লবণ তথা অপরিশোধিত লবণের মূল্য মণপ্রতি ২৮০ টাকা (মিল গেট) এবং মিল থেকে পরিশোধন করার পর মণপ্রতি তা বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকা পর্যন্ত। আর খোলা এবং প্যাকেটজাত লবণের মূল্য স্থানভেদে একেক দরে বিক্রি হয়ে থাকে। যা মিল গেটে আয়োডিন মিশ্রিত প্রতিকেজি প্যাকেট লবণ সর্বোচ্চ ১০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে তা ১৮ থেকে ২২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ আমদানির ফিনিশড লবণ (সালফেট মিশ্রিত ক্ষতিকর) বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৫ টাকা। দেশীয় উৎপাদনের লবণ এবং আমদানি লবণের মূল্যের ব্যবধান থাকলেও ভোক্তাদের অন্যতম আকর্ষণ আমদানির ইভাপোরেটেড লবণ (যা সালফেট মিশ্রিত)। তাতে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষীরা এবং লবণ মিল মালিকরা নিয়মিত লোকসানের মুখে রয়েছে। এ অবস্থায় দেশীয় লবণ শিল্পকে বাঁচাতে আন্দোলন সংগ্রামে নামছে মূলত প্রান্তিক চাষীরা। সহযোগিতায় রয়েছেন মিল মালিকসহ এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সংশ্øিষ্ট সংস্থা ও সংগঠনগুলো। আন্দোলন শুরুর পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতির পক্ষে সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করা হয়েছে, এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে দেশীয় লবণ শিল্পের ধ্বংস অনিবার্য। ইতোমধ্যে প্রান্তিক চাষীরা হতাশায় রয়েছে। বিগত মৌসুমে সকল পর্যায়ে শুধু লোকসান আর লোকসান গুনতে হয়েছে। ইতিমধ্যে গত ডিসেম্বর মাস থেকে নতুন মৌসুমের সূচনা ঘটেছে। আগামী মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ মৌসুম চলবে। এ অবস্থায় লবণ মাঠ মালিকরা যেমন চাষীদের মাঠ লাগিয়ত করতে পারছে না, তেমনি প্রাস্তিকক চাষীরাও আশানুরূপ পর্যায়ে লবণ উৎপাদনে সাহস করছে না।
অন্যদিকে বাংলাদেশে লবণ মিল মালিকদের সংগঠনের নাম বাংলাদেশ লবণ মিল মালিক সমিতি। ওই সমিতির অধীনে তিন শতাধিক মিল রয়েছে। ওই সমিতি ৮ অঞ্চলে বিভক্ত। যা কক্সবাজার, পটিয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, ঝালকাঠি ও চাঁদপুরভিত্তিক। ওই সমিতির অধীনে থাকা মিল মালিকদের দুঃখ-দুর্দশার কথা দফায় দফায় বিভিন্ন সভা সমাবেশের মাধ্যমে সরকারের নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কর্ণকুহরে পৌঁছানো হলেও কোন সুফল মিলছে না বলে দাবি করেছেন সমিতির সভাপতি নূরুল কবির। তিনি দাবি করেন, চাষীরা না বাঁচলে মিল মালিকদের যেমন অস্তিত্ব থাকবে না, অনুরূপভাবে মিথ্যা ঘোষণায় বিদেশ থেকে সোডিয়াম ক্লোরাইড আমদানি অব্যাহত থাকলে দেশীয় লবণ শিল্প আরো বিপর্যয়ের মুখে চলে যাবে।