সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব মামলা জালে আটকে রয়েছে। রাজস্ব আদায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জোর তৎপরতা চালালেও অনেক ক্ষেত্রেই মামলার কারণে তা সফল হচ্ছে না। বর্তমানে উচ্চ আদালত ও রাজস্ব-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালগুলোয় ২২ হাজারের বেশি মামলা রয়েছে। আয়কর, ভ্যাট ও আমদানি শুল্কের ওসব মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব হচ্ছে না। রাজস্ব-সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনাল ও উচ্চ আদালত সূত্রে এ তথ্য জানা যায়
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, স্বার্থান্বেষী মহল বিচার বিভাগের চলমান দীর্ঘসূত্রতা কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আটকে রেখেছে। তারা মামলাকে রাজস্ব আটকানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। শুধু বড় শিল্প গ্রুপ বা প্রতিষ্ঠানই যে রাজস্ব ফাঁকি দিতে মামলা করছে তা নয়, মাঝারি থেকে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরাও অনেক সময় ভ্যাট-ট্যাক্স-সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে। আবার বন্ড সুবিধার অপব্যবহারকারীরাও আদালতে মামলা করে আটকে রাখছে হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। আর রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা বেশিদিন ঝুলে থাকা মানে সরকারের কোষাগারের ওপর ধারাবাহিক চাপ সৃষ্টি হওয়া। বর্তমানে রাজস্ব-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে একাধিক বেঞ্চ নির্ধারিত থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়।
সূত্র জানায়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে ভ্যাট বা ট্যাক্স দাবি করলে তার বিরোধিতায় আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে অ্যাপিলেট ট্রাইব্রুনালে আবেদন বা উচ্চ আদালতে রিট দায়ের করা যায়। উচ্চ আদালত রিট দায়ের করার পর আবেদন খারিজ করে এনবিআরে পাঠাতে পারে। সে ক্ষেত্রে এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে হয়। সেজন্য দাবিকৃত অর্থের ১০ শতাংশ পরিশোধ করতে হয়। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজনীয় শুনানি শেষে রায় দেয়। তারপর বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান ফের উচ্চ আদালতে আপিল করে। এভাবে বছরের পর বছর গড়িয়ে যায়। অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের আওতায় আয়কর খাতের জন্য ৭টি বেঞ্চ এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ও শুল্ক খাতের জন্য ৩টি বেঞ্চ রয়েছে। ওসব বেঞ্চে অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের দুটি শাখায় মামলা-সংক্রান্ত সব কার্যক্রম শুনানি ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এনবিআরের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালের দুটি আদালতে এক মাসে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৭টি মামলার শুনানি সম্ভব। তবে কোনো কোনো মাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সাক্ষীর অনুপস্থিতিসহ বিভিন্ন সমস্যায় তার চেয়ে কমসংখ্যক মামলার শুনানি হয়। কিন্তু ওসব বিভাগে প্রতি মাসে গড়ে একশ থেকে দেড়শ নতুন মামলা যুক্ত হয়। ফলে প্রতিদিনই নিষ্পত্তি হওয়া মামলার তুলনায় অনিষ্পত্তি মামলার সংখ্যা বাড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) পদ্ধতিতে কিছু মামলা নতুন করে নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট কমিশনারেটগুলোয় বড় যেসব করদাতা মামলায় আছে, তারা এডিআরে যাতে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে পারে সে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এডিআরের বিষয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে উচ্চ আদালতের আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের আদালতে মামলার জটের সুযোগ নিচ্ছে সুযোগসন্ধানীরা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী মামলাকে রাজস্ব ফাঁকির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। যেহেতু সরকার এখানে ক্ষতিগ্রস্ত তাই সরকারকেই ওসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিতে হবে। এনবিআরের উচিত প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করে এ-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন জানান, সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব মামলার কারণে আটকে থাকা দুঃখজনক। তবে এখানে রাজস্ব কর্মকর্তাদেরই অনেক ত্রুটি রয়েছে। তারা যদি আমদানি পণ্যের সঠিক মূল্যায়ন বা রাজস্ব আদায় তদারকি করতেন তাহলে এতো মামলার উদ্ভব হতো না। বর্তমানে হাই কোর্টে রাজস্ব মামলা-সংক্রান্ত অনেক বেঞ্চ। এখন এনবিআরের উচিত হবে মামলাগুলো শ্রেণিবিন্যাস করে শুনানির জন্য উপস্থাপন করা। তা হলেই ওসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হবে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে এনবিআরের আইন কর্মকর্তা মো. লিয়াকত আলী জানান, রাজস্ব আটকে রাখা মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে এনবিআর থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে সব সময়ই তাগিদ দেয়া হয়। কারণ এনবিআরের কোনো আলাদা লিগ্যাল উইং নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসই ওসব মামলা পরিচালনা করে। অমীমাংসিত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলে বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় হবে। এ বিষয়ে এনবিআর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। সেজন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রতিও জোর দিয়েছে এনবিআর।