সম্প্রতি পত্র-পত্রিকা ও সব গণমাধ্যমে নূতনরূপে করোনা ভাইরাসের আর্বিভাব সম্বন্ধে খবর আসছে। চীনের হুবেই (Hubei) প্রদেশ থেকে এই ভাইরাস ছড়াচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে। চীনা কতৃপক্ষ প্রথমে জানিয়েছিল যে, এই পর্যন্ত চীনে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে ৬২ জন, যার মধ্যে ২ জন মারা গেছে। কিন্তু বৃটিশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, এই তথ্য সঠিক নয়। বৃটেনের ইম্পেরিয়াল কলেজ ভিত্তিক এম আরসি বৈশ্বিক সংক্রামক রোগ বিশ্লেষন সংস্থা (MRC Centre for Gobal Infectious Disease Analysis at Imperial College) উদ্ঘাটিত করেছে যে, এ পর্যন্ত (২০ জানুয়ারি ২০২০) হুবেই প্রদেশের প্রায় ১৭০০ জন আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনুরূপ তথ্য দিয়েছে। তবে ডিসেম্বর ২০১৯ সালেই এই আক্রমন শুরু হয়। উহান (Wuhan) শহরের হুয়ানানের (HuaNan) একটি কেন্দ্রীয় পশু ও মাছ বা সামুদ্রিক খাবারের বাজার থেকে এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়েছে যে শহরের জনসংখ্যা ১১ মিলিয়ন বা ১ কোটি ১০ লাখ। এজন্য এই ভাইরাস ‘‘ উহান ভাইরাস’’ বলে পরিচিতি লাভ করেছে চীনে। এই শহরটি যান তৈরী ও মেরামতের কেন্দ্রস্থল যা অনেকটা আমাদের ধোলাইখালের মত । পরিবেশটি স্বাস্থ্য পরিপন্থী বা দূষিত। এই জন্যই হয়তো এই রোগে শ্বাসকষ্ট হয়। জানুয়ারি ২০২০ থেকেই বাজারটি জীবানু/ ভাইরাস মুক্ত ও পানি-ময়লা নিষ্কাশনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে ২০০২-০৩ সালে চীনে সার্স (SARS) Severe Acute Respiratory Syndrome) নামক ভাইরাসের আক্রমনে ৬৫০ জন মানুষ মারা যায়। সারা বিশ্বে তখন ৭০০-এর বেশী লোক মারা যায় এবং ৮০০০ লোক আক্রান্ত হয়। বর্তমান করোনা (Corona) ভাইরাস তারই একটি রূপান্তরিত বা সংশ্লিষ্ট একটি ভাইরাস বলে ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা নূতনভাবে সতর্কতার সংকেত দিয়েছেন। আশংকা করা হচ্ছে যে চান্দ্র বছরের শুরুতে চীনে যে নববর্ষের ছুটি দেয়া হয় যখন লক্ষ লক্ষ লোক আতœীয় স্বজনের সাথে মিলনের জন্য দেশের আনাচে কানাচে বেড়াতে যাবে তখন এই ভাইরাসের ব্যাপক আদান প্রদান হতে পারে। সেটি মহামারী আকারে দেখা দিতে পারে বলে আভাষ দেয়া হচ্ছে। তাই চীন এ উপলক্ষে এই যাতায়াত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে দুই জন করে এবং জাপান ও সিংগাপুরে একজন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে গবেষকগণ এই বার্তা প্রচার করেছেন। অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সেও আক্রান্ত রুগী সনাক্ত করা হয়েছে। চীনে দেশব্যাপী ইতোমধ্যে ২০০০-এরও বেশী লোক আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জন মারা গিয়েছে বলে চীনা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে (২৩ জানুয়ারী ২০২০)। তবে বেসরকারী হিসেবে এই সংখ্যা অনেক বেশী। মৃতের সংখ্যা ৪৫ -এ পৌঁছেছে বলে জানা গিয়েছে (২৫ জানুয়ারি ২০২০)। দৈনিকই মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি দিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০ জানুয়ারী ২০২০ থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চীন থেকে আগত যাত্রীদের বিশেষভাবে স্কিৃনিং(screening) করা শুরু হয়েছে। বিমানবন্দরে যাত্রীদের উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য বিমানবন্দরেও এই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সরকারের ‘রোগতত্ত্ব , রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান’ আইইডিসিআর (IEDCR) কর্তৃক বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকে এ ব্যপারে সতর্ক করে চিঠি দেয়া হয়েছে। সরকার বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মীদের করোনা ভাইরাস বিষয়ে ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার উপর প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করছে এবং হাসপাতালসমূহে অনুরূপ নির্দেশনা ও ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন এয়ারলাইন্স ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে বৈঠকও করেছে। তিনটি থার্মাল স্ক্যানারের মাধ্যমে বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের এই রোগে সম্ভাব্য আক্রান্তদের উত্তাপ মাপার মাধ্যমে প্রাথমিক ভাবে কেউ আক্রান্ত কিনা তা সনাক্ত করার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সতর্কতা নেয়া হয়েছে বেনাপোল স্থলবন্দরেও। তাই আপাতত: আমাদের ভয়ের কিছু নেই বলে আইইডিসিআর আমাদের আশ্বাস দিলেও আগামী দিনের জন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। একইভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন বিমানবন্দরেও স্ক্যানিং করা শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, উহান থেকে সরাসরি যে ফ্লাইটগুলো আসছে এবং লস এঞ্জেলেসের মত যে সব বিমানবন্দরে বিভিন্ন দেশের ফ্লাইট বিনিময় হয় সে সব বিমানবন্দরে স্ক্যানিং শুরু হয়েছে। থাইল্যান্ড সহ অন্যান্য দেশও অনুরূপ ব্যবস্থা নিচ্ছে। চীন এখনো (২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত) কোন ভ্রমন বিধিনিষেধ জারি না করলেও হংকং কর্তৃপক্ষ চীন থেকে ভ্রমন করা যাত্রীদের জন্য তাপমাত্রা মাপার ব্যাপক ব্যবস্থা নিয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা দৈনিকই বৃদ্ধির কারণে চীন নতুন বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা সহ প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে। বাংলাদেশে যাতে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও সতর্কতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যেগ নিয়েছে। উত্তর কোরিয়া বিদেশী পর্যটকদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সর্বশেষ জানা যায় যে, চীনের ১৪টি শহরেও পর্যটকের আগমন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
চীনের উহান শহর থেকে কোন ব্যক্তিকে ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এই শহরে ৫০০ বাংলাদেশী অবরূদ্ধ রয়েছে এবং তারা আতংকগ্রস্ত রয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগে জানিয়েছে। করোনা ভাইরাস এখনো ব্যপকভাবে সম্প্রসারিত না হলেও এই ভাইরাস জনিত রোগটির প্রথমিক লক্ষণ হল, জ্বর, সর্দি, কাশি গলাব্যথা ও শ্বাসকষ্ট এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। এটির ব্যপারে এখনো যথেষ্ট তথ্যাবলী ও গবেষণা সম্পন্ন না হলেও গবেষকরা বলেছেন যে, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে সংক্রমিত হতে পারে যা ইতোমধ্যে ধরা পড়েছে। পরিবারের মধ্যে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে ঘনিষ্টভাবে বাস করে তাদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশী, তবে এটি আসলে ছোঁয়াছে কিনা সে বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিশ্চিত করে কিছু বলেনি। যদি এই ভাইরাস একজন থেকে অন্য জনে ছড়ায় তবে অতি দ্রুত সংক্রমনের সম্ভাবনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত এর প্রতিরোধে কোন ঔষধ তৈরী হয়নি বা প্রতিষেধক বের হয়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০ জানুয়ারী ২০২০ জানিয়েছে যে এটি ছোঁয়াছে এবং সম্ভবত কোন পশুর শরীর থেকে এই সংক্রমন মানুষের শরীরে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং চীনা কর্তৃপক্ষ এর প্রতিরোধে নির্দেশিকা জারি করেছে।
করোনা ভাইরাস একটি প্রাণঘাতি ভাইরাস। এটি একটি নিউমোনিয়া সদৃশ শ্বাস জনতি রোগ বিশেষজ্ঞরা যার নাম দিয়েছেন ‘২০১৯ এন সি ও ভি করোনা’ (2019-nCOV Corona)। করোনা ভাইরাস কয়েক প্রকার রয়েছে। বর্তমান ভাইরাসটি ৭ম প্রকার বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। ২০১২ সালে চীনে প্রথম এটি ধরা পড়ে। সব প্রকার করোনা ভাইরাস বিপদজনক নয়। ‘মার্স’ বা মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাসযন্ত্রের সিনড্রোম নামে পরিচিত ভাইরাসটির (SARS- Severe Acute Respiratory Syndrome) আক্রমনে সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রচ্যের কয়েকটি দেশে মারাতœকভাবে সংক্রমিত হয় এবং অনেক লোক মারা যায়, যার মধ্যে একজন বাংলাদেশী ডাক্তারও ছিলেন। মার্স ভাইরাস উট থেকে ছড়িয়েছে। আরেকটি হল ‘সার্স’ বা গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রের লক্ষণ বা সিন্ড্রোম (MERS- Middle East Respiratory Syndrome) যার মাধ্যমে চীনে ২০০৩ সালে অনেক লোক মারা যায়। সার্স ক্ষুদ্রাকৃতির চিত্রা বিড়াল থেকে উদ্ভুত হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল।
প্রথমে ১৯৬০ সালে এবং পরে ২০১২ সালে করোনা ভাইরাস সনাক্ত করা হয়। কিন্তু এর উৎস কি এখনো তা স্পষ্ট নয়। মুকুটের মত দেখতে বলে এই ভাইরাসের নামকরন করা হয়েছে করোনা। এটি একটি ল্যাটিন শব্দ যার অর্থ মুকুট। এর দ্বারা মানুষ ও প্রাণী উভয়ই আক্রান্ত হয়। সাধারণতঃ এই ভাইরাসের অবস্থান প্রকৃতিতে বা প্রাকৃতিক পরিবেশে পানি ও বায়ুতে। সুযোগমত মানুষ ও প্রাণীদের শ্বাসযন্ত্রে আক্রমন করে। সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি- কাশি, এর সাথে হাত মুখের স্পর্শ, পোষাক ও ব্যবহৃত জিনিষের সংস্পর্শে আসলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এর চিকিৎসা এখনো বিশেষভাবে না হলেও অন্যান্য শ্বাস জনিত ভাইরাসে আক্রান্তদের মত নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাখা, ঠান্ডা এড়িয়ে চলা, আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা, মাস্ক ব্যবহার করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, বিশ্রাম করা ইত্যাদি মেনে চলা নিরাপদ । সচেতনতাই নিরাপত্তার মূল চাবিকাঠি। এছাড়া, আক্রান্ত বা সন্দেহ হলে ডাক্তারের পরামর্শে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষা করে উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বিশ্ব ইতোমধ্যে জিকো (উগান্ডা, মেক্সিকো), ডেংগু, চিকনগুনিয়া, ইবোলা (কঙ্গো) , নিপা (দ: এশিয়া) এসব ভাইরাসের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। করোনা ভাইরাসেরও অভিজ্ঞতা হয়েছে। সবই তীক্ত। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে নিপা ভাইরাসে আবার মৃত্যুর ঘটনা জানা গিয়েছে। ডেংগুর সংক্রমন এখনো চলমান। এক সময় কলেরা- বসন্তকে মহামারী বলা হত। বসস্ত নির্মূল হয়েছে। কলেরা কোন বিশেষ বা ভাইরাস জনিত রোগ নয়। দূষিত পানি ও খাদ্যের মাধ্যমেই তা হয়। আগেও হয়েছে, আগামীতেও হবে। ব্যাক্টেরিয়া খাদ্যে প্রবেশ করলে পেটের পীড়া ছাড়া অন্য রোগও হতে পারে। উপরোক্ত ভাইরাস জনিত রোগ কোন কারণ ছাড়া হয় না। ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস বা অন্য কোন দূষণ বা সংক্রমনের মাধ্যমেই এসব হয়ে থাকে। প্রকৃতি দূষণ, জলবায়ূ দূষণ, বায়ু দূষণ, খাবার দূষণ অর্থাৎ যে কোন রকম দূষণ বা অপরিছন্নতাই রোগের কারণ। আবার পশু, প্রাণী, কীট পতংঙ্গ বা যে কোন জীবজন্তুুর মাধ্যেমে রোগ তৈরি হয়। সবকিছুর মূলেই অপচ্ছিন্নতা, অনিয়ম , অশোভন, অকাজ, কুকাজ এসব। যে মুখ দিয়ে বাদুর, কুকুর, বিড়াল, উট, গরু বা যেকোন প্রাণী কোন পাত্র থেকে কিছু খায়, সে পাত্রে, আমরা খেলে তার মুখ নিসৃত লালার মাধ্যমে ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসে আক্রমন করার সম্ভাবনা থাকে। আবার একই পাত্রে, যেমন এক গ্লাস দিয়ে কয়েক জনে পানি খেলে সেখান থেকেও সংক্রমন হতে পারে। সেজন্য পরিচ্ছন্নতা প্রয়োজন। নিয়ম-বিধি না মেনে চলে জীবন যাপন করলে, খাওয়া-দাওয়া ইচ্ছেমত করলে রোগ হতেই পারে। এইসব বিধি নিষেধ স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা ব্যবস্থায় আছে, সামাজিক ও সরকারী বিভিন্ন সংস্থায় আছে। সর্বোপরি ধর্মে বা ধর্মীয় অনুশাসনে আছে। আমরা মানতে চাইনা। পরিবেশ দুষণ বা জলবায়ু দূষণ আমরাই করে থাকি। তাই নূতন নূতন বা অজানা অদ্ভুত ভাইরাস বা রোগ আক্রমন করে। আমরা যেমন প্রকৃতির বিরোধিতা করছি প্রকৃতিও নূতন নূতন রোগ ব্যাধি দিয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। সতর্কতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ করা, নিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন করা, ধর্র্মীয় অনুশাসন মেনে চলা- এসবই আমদেরকে মারাতœক বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে।
অধ্যক্ষ ও কলাম লেখক