বিগত আট বছর বেশ ভালোই কেটেছিল ঢাকা ভিত্তিক কম্পিউটার প্রকৌশলী খোকন। বিয়ে না করেও এক ছাদের নিচে সুখেই দিন কাটাচ্ছিলেন এক মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু বিয়ের কথা তুলতেই ঘটে যত বিপত্তি। জাত-বর্ণের কথা তুলে ওই মেয়েকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। পরিবারের সম্মতিক্রমে তিন মাস আগে বিয়ে করেন আরেকটি মেয়েকে। কিন্তু আট বছর একসঙ্গে কাটানোর পর এখন বিয়ে না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা ঠুকে দিয়েছেন তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গিনী। নতুন বিবাহিত জীবন উপভোগ করা তো দূরের কথা, বরং জেলের ঘানি টানতে হতে পারে ঢাকার এই কম্পিউটার প্রকৌশলীকে। তাঁর জামিনের আশার গুড়েও বালি ঢেলে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিশেষ বেঞ্চ। ছেলেপক্ষের আইনজীবী শুনানিতে যুক্তি দেখান, ‘গত আট বছরে মেয়েটি তো কখনো ধর্ষণের অভিযোগ তোলেননি। কিন্তু যখন তিনি বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তখন প্রতিহিংসাবশত এই মামলা করা হয়েছে। কিন্তু বিচারকেরা মেয়েটির প্রতিই সহানুভূতি দেখিয়েছেন। বিচারক নাহিয়ান ও ফাল্গুনী আহমেদ আসামির উদ্দেশে বলেছেন, ‘আপনি আট বছর ধরে এই মেয়েটির সঙ্গে কাটিয়েছেন। কিন্তু শুধু অন্য একজনকে বিয়ে করার জন্য এখন তাঁকে পরিত্যাগ করতে যাচ্ছেন। এটাই হয়তো এই অভিযোগের কারণ হতে পারে। কিন্তু আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে।’ ২০০৪ সালে প্রথম পরিচয় হয়েছিল এই দুজনের। এরপর তাঁরা ২০১১ সালের শেষ পর্যন্ত একসঙ্গে কাটিয়েছেন। পরে মেয়েটি বিয়ের জন্য চাপ দিলে ছেলেটি জাত-ধর্ম, পরিবার-সমাজের অজুহাত তুলে তা এড়িয়ে যান। এবং পরিবারের সম্মতিক্রমে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেন। এ কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই গত ৪ ফেব্রুয়ারি ছেলেটির নামে ধর্ষণের মামলা ঠুকে দেন আট বছরের সঙ্গী সেই মেয়েটি। এই মেয়েটির নাম তানশা। তখন দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। তাঁর স্বপ্ন, বড় মডেল হবেন। টিভির পর্দা খুললেই ছবি ভেসে উঠবে। সব স্বপ্ন কি সত্যি হয়? তানশা ঠিকই সেই স্বপ্ন সত্যি করেছেন। শুরুটা হয়েছিল কাদের বাবুর হাত ধরে। সেই সহায়তার হাত ধরে তানশা চলে গেল বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থায়। একদিন ডাক এল। বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ করলেন। এরপর আপন জুয়েলার্সের বিজ্ঞাপনটি টিভিতে প্রচারিত হওয়ার পর তানশাকে চিনলেন নাটকের লোকজন। শায়ের খান তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করলেন ডানা কাটা শায়েরি নামের একটি ধারাবাহিক নাটক। এরপর তানশা এগিয়ে যেতে থাকলো বিভিন্নভাবে। তানশার কাছে মনে হলো, সবকিছুই যেন স্বপ্নের মতোই এগিয়ে চলেছে। সেই স্বপ্নেই বিভোর তিনি। ‘নাটকের কাজ করতে করতেই আসলে আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিলাম। এ সময় নিয়ন ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলাম। সিনেমা করব, এটা কি ভেবেছি! আমার বাসা থেকেও আসলে অনুমতি ছিল না। যখন গল্পটা শুনলাম, তখনই আমি বাসার সবাইকে বোঝালাম। তাঁরা রাজি হলেন। সিনেমায় কাজ শুরু করলাম। প্রথম দিন তো ভীষণ নার্ভাস ছিলাম। তবে কাজটা করে বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে কি ঠিক করছি, নাকি ভালো হচ্ছে।’ এভাবেই প্রথম ছবি মেহেরজান-এ কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তানশা। ছবি মুক্তির আগে উদ্বোধনী প্রদর্শনী হলো। সেখানে তানশা খুবই উৎকণ্ঠায় ছিলেন। ছবি শুরুর আগে তিনি একধরনের থমথমে পরিবেশ অনুভব করছিলেন। ছবি দেখা শেষে মানুষের কাছ থেকে ইতিবাচক মন্তব্য শুনে চোখের পানি যেন ধরে রাখতে পারছিলেন না। ‘আমি খুব করে চাইছিলাম যে ছবিটি ভালো হিসেবে মানুষের কাছে বিবেচিত হোক, আর আমার কাজটা যেন তাদের চোখে পড়ে। সেটাই হয়েছে। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে, আসলে চেষ্টা থাকলে সবকিছুই করা সম্ভব।’ বললেন তিনি। নিয়ন ছবিতে কাজ করার পর তানশা বলেছিলেন, তিনি আগামী ছয় মাস কোনো ছবিতে অভিনয় করবেন না। পড়াশোনায় মনোযোগ দেবেন। কিন্তু নার্গিস আক্তার যখন তাঁকে পুত্র এখন পয়সাওয়ালা ছবির গান শোনালেন, তখন তানশার মনে হয়েছে, এ ধরনের ছবিতে কাজ করতে পারাটা আনন্দদায়ক। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। মাসুদ আকন্দ ‘পিতা’ নামের একটি গল্প নিয়ে গেলেন। সেটিও পছন্দ হলো। তানশা সেই ছবিটিও করলেন। দুটি ছবিই এখন মুক্তির মিছিলে রয়েছে। জানতে চাইলাম সিনেমায় কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা ছবিতে ববিতা আপা আছেন। এত বড় মাপের শিল্পীর সঙ্গে কাজ করার আগে আমার গলা শুকিয়ে যেত। হাত-পা আর নাড়াতে পারতাম না। কেমন যেন জড়তা চলে আসত নিজের মধ্যে। ধীরে ধীরে কাজ করতে করতে আমি স্বাভাবিক হয়ে কাজ করেছি।’ তানশাকে এরই মধ্যে আরও বেশি জনপ্রিয় করে তোলে শহীদের গাওয়া ‘এক জীবন’ গানের মিউজিক ভিডিওটি। শায়নার কিন্তু কাজটা করার ইচ্ছাই ছিল না। অনুরোধে কাজটি করার পর এখন তিনি মনে করেন, কাজটি তাঁর ক্যারিয়ারকে এগিয়ে নিতে খুবই সহযোগিতা করেছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন শায়না। আর ঠিক তখনই শোনা গেল, তিনি বিয়ে করেছেন। তানশা প্রথমে অবশ্য কিছু বলেননি। ‘ও মিডিয়ার বাইরের মানুষ। পড়াশোনা করছে। আসলে, আমাদের দুজনের পরিচয় ছিল। ও আমাকে পছন্দ করত। আমার সম্পর্কে খোঁজখবর রাখত। ধীরে ধীরে আমাদের সম্পর্কটা আরও ভালো হয়। তারপর দুজনে সিদ্ধান্ত নিই, বিয়ে করব। ব্যস, বিয়েটা করে ফেললাম।’ এখন আর কাজ করবেন না? প্রশ্ন শুনে একটু বিস্মিত তিনি। ‘কেন করব না? সামনেই আমি বিজ্ঞাপনচিত্রে কাজ শুরু করব। এরপর নাটকের কাজের প্রস্তাব আসছে। সেখান থেকে বেছে বেছে কাজ করব।’
তানশার কাছে জানতে চাইলাম, একসঙ্গে অনেক মাধ্যমে কাজ করছেন। আসলে আপনি কোন দিকে নিজেকে সফল দেখতে চান?
তানশার উত্তর, ‘আমি নাটক, বিজ্ঞাপন ও সিনেমায় কাজ করব। যখন যেখানে ভালো লাগবে, সেখানেই কাজ করব। তবে গতানুগতিক কোনো সিনেমায় কাজ করতে চাই না।’ এটা ছিল তাঁর একটি সাক্ষাৎকার ভিত্তিক জীবন কথা। কিন্তু বাস্তবতা হলো এই যে, দীর্ঘ ৮ বছর যাবৎ ভালোবাসার আড়ালে তানশার সাথে খোকন পেতেছিল প্রতারণার জাল। যে জালে আটকে তানশা সব হারালেও খোকন পেয়েছিল নারী স্বাদ। এই স্বাদ পেতে বেঁকে বসা খোকনের বিরুদ্ধে আদালত যখন রায় দিল; তানশার চোখে ভেসে উঠলো দীর্ঘ আট বছরের স্যালুলয়েড...