আশানুরূপ বাড়েনি রেলসেবার মান। বরং রেল খাতে সরকার বিপুল বিনিয়োগ করা সত্ত্বেও সম্প্রতি ৫০ শতাংশ ট্রেনের রানিং টাইম (প্রারম্ভিক স্টেশন থেকে গন্তব্যে পৌঁছার সময়) বাড়ানো হয়েছে। আর এভাবে রানিং টাইম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিতে রেলসেবা মানের ক্রমাগত নিম্নমুখিতারই ইঙ্গিত। রেলওয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিটি) অনুযায়ী পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের ৪৬টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে ২১টির রানিং টাইম বাড়ানো হয়েছে। সামান্য কমেছে ১৬টি ট্রেনের রানিং টাইম। অপরিবর্তিত রয়েছে ৮টির। আর পশ্চিমাঞ্চল রেলের ৪২টি আন্তঃনগর ট্রেনের মধ্যে রানিং টাইম বেড়েছে ১৮টির। কমেছে ১৪টির। অপরিবর্তিত রয়েছে ১০টির। উভয় অঞ্চলের আন্তঃনগর ট্রেনগুলোর মধ্যে কোনো কোনো ট্রেনের রানিং টাইম সর্বোচ্চ ২ ঘণ্টা পর্যন্ত বেড়েছে। আর রানিং টাইম কমে যাওয়া ট্রেনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগের সময় কমেছে মোটে ৫ থেকে ২০ মিনিট। বাংলাদেশ রেলওয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বিগত ২০০৭-১০ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের ৩ বছর বিনিয়োগ প্রোগ্রামে বিনিয়োগ হয়েছে ২ হাজার ৯৬৯ কোটি টাকা। তারপর ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) খাতটিতে বিনিয়োগের লক্ষ্য রাখা হয় ৪৩ হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। চলমান সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০) ওই লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬৬ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। বিনিয়োগ ও বিনিয়োগ পরিকল্পনায় বরাদ্দের পরিমাণ ক্রমে বাড়লেও রানিং টাইম বেড়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অভিযোগ উঠেছে, বিপুল বিনিয়োগের পরও ব্যবস্থাপনাগত নানা অসঙ্গতি ও দুর্নীতির কারণেই রানিং টাইম বাড়ছে।
সূত্র জানায়, রেলের বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প শেষ হলেও তা সুষম হয়নি। ট্র্যাকের উন্নয়ন করার পাশাপাশি নতুন কোচ আনা হলেও অধিকাংশ ইঞ্জিনই মেয়াদোত্তীর্ণ। তাছাড়া সিংহভাগ সেতু, কালভার্ট এখনো জরাজীর্ণ। স্টেশন বন্ধ থাকায় ট্রেনগুলো কাক্সিক্ষত গতি পাচ্ছে না। ওসব কারণে সেকশন অনুযায়ী ট্রেন চালানোর সক্ষমতা কমে যাওয়ায় ট্রেনের রানিং টাইম কমানো সম্ভব হচ্ছে না। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি রেলওয়ের সর্বশেষ টাইম টেবিল বাস্তবায়ন হয়েছে। তার আগের টাইম টেবিলটি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল ২০১৭ সালের ১ মার্চ। প্রতি বছর সময়সূচি পুননির্ধারণ করে নতুন টাইম টেবিল বাস্তবায়নের কথা থাকলেও এবার নতুন টাইম টেবিল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সময় লেগেছে ২ বছর ১০ মাস। এই সময়ে রেলওয়ের একাধিক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়াও নতুন নতুন কোচ সংযোজন, ট্র্যাক সংস্কার, কালভার্ট ও ব্রিজ সংস্কার, নতুন নতুন সেতু নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আর তার ধারাবাহিকতায় রেলের প্রায় প্রতিটি ট্রেনের সময়সূচিতেই রানিং টাইম কমে আসার কথা ছিল।
সূত্র আরো জানায়, ঢাকা-চট্টগ্রাম দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ রেলরুট। ওই রুটটিতে যাত্রীদের ঘনত্বও অনেক বেশি। ১৯৮৫ সালের দিকে ওই রুটে প্রথম আন্তঃনগর ট্রেন চালু হয়। তখন ওই রুটে যাত্রী চলাচলে সময় লাগত খুবই কম। পরবর্তী সময়ে রেলের বিনিয়োগ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়লেও ওই রুটে ট্রেনের রানিং টাইমও বেড়েছে। বিভিন্ন সময় রেলওয়ে আশ্বাস দিয়েও রানিং টাইম কমাতে পারেনি। যদিও ইতিমধ্যে ৩২১ কিলোমিটার দীর্ঘ রেল রুটটিতে দুটি ডাবল ট্র্যাকের সেতু (তিতাস ও ভৈরব) নির্মাণ হয়েছে। ডাবল লাইন হয়েছে লাকসাম থেকে চিনকি আস্তানা পর্যন্ত এবং টঙ্গী থেকে ভৈরব বাজার পর্যন্ত রেলপথ। আর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে টঙ্গী পর্যন্ত রেলপথ ডাবল লাইন আগে থেকেই ছিল। তাছাড়া ওই রুটের পুরনো ট্র্যাকগুলোও সংস্কার করা হয়েছে। তারপরও রেলওয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে বিরতিহীন ট্রেনের রানিং টাইম ৫ ঘণ্টার নিচে নামিয়ে আনতে পারেনি। বরং সর্বশেষ প্রণীত টাইমটেবিলে বিরতিহীন সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের রানিং সময় ১০ মিনিট করে বাড়িয়ে ৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট করা হয়েছে।
এদিকে এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাসির উদ্দিন আহমেদ জানান, রেলের অনেক চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। ফলে নতুন ট্র্যাক, কোচ ও একাধিক উন্নয়ন হলেও অস্থায়ী গতি নিয়ন্ত্রণাদেশের কারণে ট্রেনের গতি কমে যায়। তাছাড়া ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয়সহ বিভিন্ন কারণে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে ট্রেনের রানিং সময় বাড়ানো হয়েছে। ট্র্যাক, সেতু, কালভার্টসহ একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে আগামীতে ওসব বর্ধিত রানিং টাইম সমন্বয় করা হবে।