বাংলাদেশের একটি উপজেলায় গিয়েছিলাম একটি সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বাস্তবায়ন কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য। অনুষ্ঠানটি মিডিয়া কাভারেজের জন্যে কিছু মিডিয়াকর্মীদেরকে ঐ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। সেখানে আমার সহকর্মী উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন, এমন সময় একজন সাংবাদিক কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, গতকালের প্রোগ্রামের নিউজটা তো ইউএনও, ওসি স্যারসহ সবাই দেখেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। ইউএনও ম্যাডাম নিজে কমেন্ট করেছেন এবং সাথে সাথে অ্যাকশন নিয়েছেন। আমি মনে মনে ভাবছিলাম। না জানি, ঊনি কোন নামকরা মিডিয়াতে কাজ করেন, ঊনার নিউজের এত গুরুত্ব দিয়েছে প্রশাসন! পরে আমার সহকর্মীকে কানে কানে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা, যিনি নিজের নিউজের সাফাই গাইলেন, তিনি কোন পত্রিকা বা টেলিভিশন মিডিয়ায় কাজ করেন? দাদা, পরে আমায় বললেন, দাদা, ওনি কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনে কাজ করেন না। ঊনি একটা ফেসবুকের একটা অনলাইন পাবলিক গ্রুপে লেখেন। সেটাতে পোস্ট করা নিজের নিউজের কথাই বলছিলেন। সেই সাথে আরো বিস্তারিত জেনে ঊনার সাংবাদিকতা সম্পর্কে অবগত হলাম।
আমার এক ভাগ্নে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। চান্স পেয়েছে একসাথে দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথমটি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস কমিউনিকেশন এ- জার্নালিজম বিষয়ে, অপরটি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে। ভাগ্নে বললো, মামা আপনি তো সাংবাদিক, তাই আমাকে একটা পরামর্শ দেন, কিসে ভর্তি হবো? আমি বললাম মামা, আমি একসময় সাংবাদিকতা করতাম, এখন সঙ্গত কারণেই সাংবাদিকতা করি না, তবে অনেক সাংবাদিকগণের সাথেই ভালো পরিচয় আছে। এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাংবাদিকতা বিভাগের একজন প্রাক্তন ছাত্রের সাথে ভাল পরিচয় আছে, আমি তার সাথে কথা বলে তোমাকে জানাবো। পরে ঐ বিষয়ের প্রাক্তণ শিক্ষার্থী ভাই আমাকে বললেন, ভাই, আমাদের দেশে এখনও জার্নালিজমের সুন্দর সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠেনি। সেই সাথে এখন অনেক চ্যালেঞ্জিং হয়ে গেছে। মিডিয়া হাউসগুলোতে বেতন কাঠামোর খুব খারাপ অবস্থা। আমি নিজেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পায়েছিলম, কিন্তু পছন্দসই বিষয় পাইনি বলে ভর্তি হই নি। সেই সাথে সাংবাদিকতায় ভর্তি হয়েছিলাম এই সাবজেক্টের গ্ল্যামারের কথা ভেবে। কিন্তু এখন মনে হয়, আমি হয়তো ভুলই করেছি। বরং এর ম্যানেজমেন্ট বিষয়টা পুরো কর্পোরেট বিশ্বে একটা ভালো গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেই সাথে উচ্চশিক্ষার সুযোগটাও অবারিত আছে। আমার মনে হয়, অযথা জেনে বুঝে সাংবাদিকতায় পড়ে ঝুঁকি নেয়ার দরকার নেই।
জেলা শহর জুড়ে তিনি একজন সুপরিচিত সাংবাদিক। জেলা শহরের সবাই ঊনাকে সাংবাদিক হিসেবেই জানেন ও চিনেন। বলা যায় কিছুটা জাঁদরেল সাংবাদিক হিসেবে! রাস্তা ঘাটে ঊনাকে কেউ সাংবাদিক ছাড়া ডাকেন না। প্রশাসন ও জনসাধারণের আয়োজিত সকল কর্মসূচিতেই ঊনি আমন্ত্রিত হন। ঊনার আসল পরিচয় হলো, ঊনি স্থানীয় একটি দৈনিকের ফটো সাংবাদিক। কাঁধে একটি ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেড়ান সব সময়। ঊনার সাংবাদিকতার পরিচয়ের কারণে, কিছুকিছু ছোট ব্যাবসায়ী ঊনার কাছে ঠিকমতো পাওনা টাকা চাইতেও লজ্জ্বা পান। আর যেকোন বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে সিগারেট নিয়ে খাওয়ার ক্ষেত্রে টাকা দেয়ার প্রয়োজনই মনে করেন না। আর ব্যাবসায়ীরাও এই টাকা চেয়ে ঐ বড় সাংবাদিক কে লজ্জ্বা দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন। কারণ কখন আবার তিনি ভেজাল ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে একখানা ছবি তুলে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিবেন, তার ঠিক নেই!
যাক, এসব উদাহরণ পড়ে ভাববেন না যে, সাংবাদিক বা সাংবাদিকতা আজ চরম বিলুপ্তির পথে। বরং আমি শুধু বাংলার পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংবাদিকতার কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তুলে ধরলাম। আজো মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকগণ সমাজ পরিবর্তনের বড় অনুঘটক। গণমাধ্যম সকল অন্যায় ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে জনমত গঠনে এক অসীম শক্তি। কারণ গণমাধ্যমের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, যেটা মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে। মানুষকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করতে পারে। আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দেশি গণমাধ্যমের পাশাপাশি বিদেশী গণমাধ্যম ও সাংবাদিকগণ বিশ্বব্যাপি জনমত গঠনে এক অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এই মহান পেশার পরিচিতি কে কাজে লাগিয়ে ব্যাক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করার প্রয়াস দেখে আমার খুব কষ্টবোধ হয়। খুব খারাপ লাগে যখন দেখি কেউ নিজের পেশার পরিচয়কে বিক্রি করে সাংবাদিকতা পেশাকে কলঙ্কিত করে। আর অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, শুধুমাত্র বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নিউজ কাভার করেই যদি মোটা টাকা পাওয়া ও সাংবাদিক বনে যাওয়া যায়, তাহলে কি দরকার ফিচার বা অনুসন্ধানী প্রতিবেদন এর মতো জটিল সৃজনশিল কাজ করার? এই পেশাকে আধুনিকায়ন করতে প্রেস কাউন্সিল, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) সর্বোপরি তথ্য মন্ত্রণালয় কে আরো প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশার আধুনিক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টিতে এবং পেশার মর্যাদা রক্ষায় নিবন্ধন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আইনগত সুদৃঢ় ভিত্তি করতে হবে।
অপসাংবাদিকতা বা হলুদ সাংবাদিকতার কে রুখতে না পারলে, ভবিষ্যৎতে এই পেশায় মেধাবী তরুণরা আসতে নিরুৎসাহিত হবে। আমাদের দেশের সাংবাদিকতার দিকপালদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ইতিহাস হারিয়ে যাবে। এজন্য মিডিয়া হাউজগুলোকেও সাংবাদিকতার আইডি কার্ড বিক্রির বদলে যোগ্যতাসম্পন্ন সাংবাদিক নিয়োগ ও তাদের সর্বশেষ ওয়েজ বোর্ড অনুযায়ী নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
স্বপ্ন দেখি সেই দিনের, যেদিন গণমাধ্যম পেশায় ক্যারিয়ার গড়া নিয়ে জন্য নতুন প্রজন্ম আপন ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকন্ঠায় দিন পার করবে না, স্থানীয় সমস্যা সমাধান ও সম্ভাবনার সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানোর জন্যে সাংবাদিককেই অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গণ্য করবে। সাংবাদিকতা হবে গণমানুষের কল্যাণে কাজ করার এক মহান ব্রত। সর্বোপরি এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে সরকারের কার্যকর যুগোপযোগী পদক্ষেপের কোন বিকল্প নেই।
সুমিত বণিক
গণমাধ্যম কর্মী ও প্রশিক্ষক, ঢাকা।