মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি খাত একসময় দেশের রফতানি আয়ের শীর্ষস্থানেও উঠে এসেছিল। আর ভালো মুনাফার আকর্ষণে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন নতুন নতুন অনেক উদ্যোক্তা। কিন্তু বর্তমানে দেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি খাতে নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত। বিশ^ বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াসহ নানাবিধ কারণে প্রতি বছরই খাতটির রফতানি ও রফতানি আয় কমছে। ক্রমাগত লোকসানে পড়ে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে হিমায়িত মৎস্যজাত কারখানা। এ অবস্থায় খাতটিতে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলো ঋণ নিয়ে বিপাকে পড়ছে। কারণ ওসব ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত শত শত কোটি টাকার ঋণ এখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি করে দেশের মোট আয় হয়েছে ৪ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। আর আগের অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৪ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। ওই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে দেশে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি বাবদ আয় কমেছে ৮১ কোটি টাকা। আর পাঁচ বছর আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে এ খাতের রফতানি আয় ছিল ৪ হাজার ৬৬০ কোটি টাকা। তারপর পণ্য রফতানি বাবদ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ হাজার ২৮২ কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে খাতটি ৪ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা আয় করে। একসময় দেশে প্রায় ১৪০টি হিমায়িত মৎস্য রফতানি কারখানা ছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে অর্ধশতাধিক কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ১০৬টি কারখানা সংগঠনটির তালিকাভুক্ত থাকলেও পণ্য রফতানি করছে মূলত ৩০টির মতো প্রতিষ্ঠান। তার মধ্যে চট্টগ্রামের সাগরিকা বিসিক শিল্প জোন ও কালুরঘাট বিসিক শিল্প জোনে ৪৪টি কারখানার মধ্যে মাত্র ৫-৬টি কোনোভাবে টিকে রয়েছে।
সূত্র জানায়, ক্রমাগত লোকসানে হিমায়িত মৎস্য রফতানিসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। তার মধ্যে মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে সোনালী ব্যাংকের পাওনা ৭৩ কোটি টাকা। কক্সবাজারের কুলিয়ারচর সি ফুডসের কাছে একই ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৬৫ কোটি টাকা। সার অ্যান্ড কোংয়ের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৪৭ কোটি টাকা। চাঁদপুরের সি ফুডস করপোরেশনের কাছেও বড় অংকের পাওনা সোনালী ব্যাংকের আটকে গেছে। মেসার্স মেঘনা সি ফুডস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃষি ব্যাংকের পাওনা রয়েছে ৫৯ কোটি টাকা। মেসার্স চিটাগং সি ফুডসের কাছেও ব্যাংকটির আগ্রাবাদ শাখার একটি ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া মেসার্স ইফফাত ইন্টারন্যাশনালের কাছে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫০ কোটি টাকা, রেইনবো সি ফুডসের কাছে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১২ কোটি, মেসার্স মোস্তফা শ্রিম্প প্রডাক্টসের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ২ কোটি, মেসার্স ফিশ মার্ক এক্সপোর্টের কাছে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক নাসিরাবাদ শাখার ২ কোটি ও জিলানী সি ফুডসের কাছে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক সদরঘাট শাখার ৪ কোটি টাকার ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, মূলত আশির দশক থেকে দেশের মৎস্য রফতানি খাতে উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসতে থাকে। ২০০৪-০৫ পর্যন্ত খাতটি ভালোই ব্যবসা করেছে। মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি খাতে ভালো মুনাফার আকর্ষণে নতুন নতুন অনেক উদ্যোক্তা এর সঙ্গে যুক্ত হয়। তার মধ্যে এমন অনেকেই রয়েছে, যারা ব্যবসা না বুঝেই ¯্রফে শখের বশে এ ব্যবসায় নাম লিখিয়েছে। কেউ কেউ মৎস্য রফতানিকারী কারখানা বা প্রকল্পের নামে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ভোগবিলাসেরও নজির গড়েছে। তাছাড়া অতি মুনাফার লোভে রফতানি পণ্যে অপদ্রব্য পুশ করে অনেকে বদনামও কুড়িয়েছে। আর যে গতিতে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, সে গতিতে উৎপাদন বা রফতানি বাড়ছে না। অথচ প্রতিযোগী দেশগুলোও এ সময়ে নিজেদের সক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে এদেশের রফতানি পণ্যের কাক্সিক্ষত দাম মেলেনি। এর ধারাবাহিকতায় প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নিয়মিত লোকসান গুনতে হয়েছে। ফলে ঝুঁকিতে পড়েছে অর্থায়নকারী ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগও।
এদিকে সোনালী ব্যাংক সূত্র মতে, মেসার্স কোস্টাল সি ফুডস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ব্যাংকটির লালদীঘি শাখা থেকে ঋণ সুবিধা নিয়ে এসেছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির ঋণমান ভালো ছিল। কিন্তু ২০১৫ থেকে মৎস্য রফতানিতে মন্দার কারণে প্রতিষ্ঠানটির ব্যাংকঋণ পরিশোধেও ভাটা পড়ে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠানটির রফতানি বন্ধ হয়ে গেলে আটকা পড়ে ব্যাংকটির প্রায় ৭৩ কোটি টাকা। বহু চেষ্টার পরও পাওনা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে চেক ও অর্থঋণ মামলা করেছে সোনালী ব্যাংক। ওই ঋণের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির চট্টগ্রাম নগরীর সাগরিকা বিসিক শিল্প জোনের ৪৮ শতক জমিসহ কারখানা বন্ধক রয়েছে। কিন্তু কারখানাসহ বন্ধককৃত জমির বর্তমান মূল্য ব্যাংকের পাওনার তুলনায় খুবই সামান্য। তাছাড়া বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রিতে অনেক ঝামেলা থাকায় ভালো দরদাতাও পাওয়া যায় না। ফলে প্রতিষ্ঠানটির কাছ থেকে এ পাওনা আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংক চট্টগ্রামের জেনারেল ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গির আলম জানান, মামলার পাশাপাশি সমঝোতার মাধ্যমেও ঋণের টাকা উদ্ধারে চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান মালিকের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বিশেষ সুবিধায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে ঋণটি নিয়মিত করার চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
অন্যদিকে মৎস্য রফতানি খাত সংশ্লিষ্ট কোস্টাল সি ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা জানান, ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, উৎপাদন ও রফতানি কমার কারণে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। গত ১৫ বছরে মৎস্য রফতানি খাতের উন্নয়নে সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। পাশের দেশ ভারত একসময় আমাদের প্রতিযোগী ছিল। তারা গত ১০ বছরে প্রতি বছর হাজার হাজার টন ভেন্নামি চিংড়ি উৎপাদন ও রফতানি করছে। আর আমরা এখনো সেটি শুরুই করতে পারিনি। একই কথা জানালেন রিভারএন ফিশ অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহান চৌধুরী। তিনি জানান, হিমায়িত মৎস্য রফতানি আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। যে পরিমাণ প্রতিষ্ঠান এ ব্যবসায় এসেছে, সে পরিমাণে উৎপাদন বাড়েনি। বরং বছর বছর কমেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও রাশিয়া ছিল বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যপণ্যের প্রধান আমদানিকারক দেশ। গত কয়েক বছরে ভিয়েতনামের ভেন্নামি চিংড়ি সে বাজার দখল করে নিয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে হিমায়িত মৎস্য রফতানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বহু প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে না পেরে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএফএফইএর সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, কয়েক বছর ধরে মৎস্য রফতানি খাতের দুরবস্থা চলছে। এ খাতকে চাঙ্গা করে দেশের রফতানি আয় বাড়াতে বহুবার সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোও কয়েক বছর ধরে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি খেলাপিতেও পরিণত হচ্ছে। অথচ এ মৎস্য রফতানি খাত একসময় দেশের রফতানি আয়ে শীর্ষে ছিল।