নানা ধরনের নকশা করে বানানো বিশেষ প্রকারের কাঁথার নাম নকশি কাঁথা। আর এই নকশি কাঁথার সাঙ্গে যিনি নিজের শ্রম. মেধা ও সময় ব্যায় করে জীবনের গল্প একেছেন তিনি হলেন সোনারগাঁয়ের নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরা। লাল, নীল, হলুদ বেগুনী সহ বিভিন্ন রঙ্গিন সুতায় আর সোনামুখি ছোট্র সুইয়ের ফোরে ফোরে মনের মাধুরী মিশিয়ে একে জান বাহারী ডিজাইনের নকশি কাঁথা। এই নকশি কাঁথা তৈরী করার মাধ্যমেই হোসনে আরা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পেয়েছেন জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন সম্মাননা ও পুরস্কার।
আমাদের উপমহাদেশে নকশি কাঁথার ইতিহাস শত-শত বছরের পুরানো হলেও হোসনে আরা তার মেধা ও মনোনশীলতার মাধ্যমে এ কাজে আধুনিক মোটিফে তার নিজস্ব একটি ফর্ম তৈরী করতে পেরেছেন। সে কারণে হোসনে আরার হাতে তৈরী সুন্দর-সুন্দর এ আধুনিক নকশি কাঁথা দেশের মাটি পেরিয়ে স্থান করে নিয়েছে দেশে-বিদেশে সোপিছ হিসেবে ধনীদের ড্রইং রুমের দেয়ালে। বাংলাদেশের এই ঐতিহ্যপূর্ণ সেলাই শিল্পটি দেশের রাজশাহী, ময়মনসিংহ, যশোর ও ফরিদপুর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত হলেও সোনারগাঁয়ের নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরা জাতীয় পর্যায়ে তার নিজস্ব স্থান তৈরী করে নিয়েছেন।
সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন আয়োজিত মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসবে কথা হয় নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরার সাথে। লোক ও কারুশিল্পের উপর সরকারী এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩৫ বছর যাবৎ দেশের আনাচে-কানাচের লোকজ ও কারুশিল্পের শিল্পীদের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিক্রি, বিপনন ও জাতীয় পর্যায়ে সর্ব সাধারণের সামনে তুলে ধরার জন্য মাসব্যাপী এ মেলার আয়োজন করে আসছে। আর হোসনে আরাও এই প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত মাসব্যাপী মেলার প্রথম থেকেই তার উৎপাদিত নকশি সামগ্রী নিয়ে অংশগ্রহণ করে করে আসছে। নকশি কাঁথা শিল্পে স্বর্ণ পদক প্রাপ্ত হোসনে আরা এক দিনেই স্বর্ণ শিখরে পৌছে জাননি। এই অবস্থানে আসতে তার বহু কাঁটা বিছানো পথ পারি দিতে হয়েছে। হোসনে আরার স্বামী কাহার উদ্দিন দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুটমিলে চাকরী করতেন। ছোট ছোট তিন জন মেয়েকে নিয়ে তাদের সংসার হাসি-আনন্দে মোটামোটি সুখেই চলছিল। ১৯৮৮ সালে দেশে ভয়াবহ বন্যার সময় হঠাৎ একদিন তার স্বামী কাহার উদ্দিন সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এরপর তাদের সুখের সংসারে নেমে আসে অমানিসার অন্ধকার। পঙ্গু স্বামী আর ছোট ছোট সন্তানদের নিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে অনেক কষ্টের মধ্যে দিন কাটে তাদের।
এদিকে ছোট কালেই পুতুল খেলার ছলে সুই আর সুতা নিয়ে সেলাই করতে করতে কিছু কাজ রপ্ত হয়ে যায় তার। পরবর্তীতে সোনারগাঁ যাদু ঘরে সাহিত্যিক বাবুল মোশাররফের প্রতিষ্ঠিত নকশি কাঁথার মাঠ নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সেলাইয়ের কাজ শিখে পাকা পোক্ত করে নেন তার হাত। নকশি কাঁথার মাঠ এই প্রতিষ্ঠানে একটি বড় ওয়ালমেট তৈরী করে দিলে ৫০টাকা আর ছোট একটি ওয়ালমেট তৈরী করতে পারলে ৩০টাকা মজুরী পেতেন। এই প্রতিষ্ঠানে ৩ মাসে একটি নকশি কাঁথা সেলাই করে সবার নজরে আসেন তিনি। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। দিনে দিনে অভিজ্ঞতার পরিধি বারতে থাকে তার। তারপর রাজধানী ঢাকার বারিধারায় অবস্থিত হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠান ডিজাইন লাইন থেকে কাজ এনে শাড়ী, পাঞ্জাবী, থ্রীপিছ ইত্যাদিতে সুতার কাজ করেন। এ সময় সে তার গ্রামের মেয়েদেরকেও কাজ শিখিয়ে তাদের দিয়ে কাজ করাতেন। কাজ শেখানো গ্রামের এসব মেয়েদের দিয়ে কাজ করালে সেখান থেকে ৫/৭ টাকা করে থাকতো হোসনে আরার। বর্তমানে নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরা ও তার তিন মেয়ে নকশি কাঁথার পদ্ম নকশা, সূর্য নকশা, চন্দ্র নকশা, চাঁকা নকশা, স্বস্বিকা নকশা সহ সবকটি ডিজাইনেই কাজ করতে পারেন। নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরা সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের মাসব্যাপী কারুশিল্প মেলার শুরুর সময় থেকেই প্রতি বছর নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন। এছাড়াও প্রায় এক যুগেরও বেশী সময় ধরে ঢাকা বিশ^-বিদ্যালয়ের চারুকলা মেলা, জয়নুল আবেদীন মেলা, বিসিক কারু শিল্প মেলা, শিল্পকলা মেলা, সার্ক মেলা, ঢাকা যাদু ঘর মেলায় তার নকশি কাঁথা নিয়ে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে আসছেন। এসব মেলায় অংশগ্রহণ করে তিনি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পেয়েছেন সম্মাননা, স্বর্ণ পদক, সার্টিফিকেট ও আর্থিক পুরুস্কার। ১৪২৫ বাংলা সালের বিসিক বৈশাখী মেলায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ও বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প মেলায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার সহ স্বর্ণ পদক অর্জন করেন। নকশি কাঁথা শিল্পী হিসেবে সরকারী ভাবে শ্রীলংকা ও নাইজেরীয়ার ফেষ্টিবলে অংশগ্রহণ করেন। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার প্রাপ্ত নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরার নকশি কাঁথা সেলাইরত ছবি ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান গুগুলের উইকিপিডিয়ার (মুক্ত বিশ^কোষ) প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে।
নকশি কাঁথা শিল্পের এই গুনি শিল্পীর মনেও রয়েছে অনেক দুঃখ। তিনি বলেন, প্রকৃত শিল্পীদের সঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না। অদক্ষ ও শিল্পী নয় এমন লোকজন কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রকৃত শিল্পীদের জায়গা দখল করার চেষ্ঠা করছে। এসব সমস্যা গুলো চিহিৃত করে সঠিক শিল্পীদের মূল্যায়ন হওয়া দরকার। নকশি কাঁথা শিল্পী হোসনে আরা বলেন, এ কাজে সরকারী প্রতিষ্ঠানে প্রদর্শনীর জন্য দোকান ঘর বরাদ্ধ পেলে এবং ব্যাংক ঋণ সুবিধা পেলে আরও ভাল করা সম্ভব।