রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়নতনে একুশে পদক ২০২০ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার আহবান জানিয়েছেন
অনুষ্ঠানে ২০ জন ব্যাক্তি এবং একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বৃহস্পতিবার একুশে পদক তুলে দেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ‘জাতির পিতা ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন ,তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা পালনে করেন । কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে ,তার নাম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল । ইতিহাস কেউ মুছে ফেলতে পারেনা ,ইতিহাস ত ইতিহাসই’ ।‘ বাস্তবতা হলো ১৯৪৮ সাল থেকেই পাক হানাদার বাহিনী জাতির পিতার প্রতি নজর দেয় । গোয়েন্দা প্রতিবেদনের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আইবি (গোয়েন্দা) রিপোর্টে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলা হয়- ১৯৫২ সালে জেলে থেকেও তিনি ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। জেলে গিয়ে ছাত্ররা তার সঙ্গে দেখা করতেন। তারা দেখা করতে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গিয়ে কী কথা বলতেন, তা শোনার জন্য বাইরে থেকে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু কিছু শুনতে পাইনি। দায়িত্বরত পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল: ছাত্ররা যেনো জেলে এসে বৈঠক করতে না পারে, কিন্তু পুলিশ তা শোনেনি।’
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে আরও বলেন, ‘পৃথিবীর কোনও দেশেই কোনও নেতার বিরুদ্ধে লেখা গোয়েন্দা প্রতিবেদন কেউ প্রকাশ করেনি। আমি এটা করেছি। কারণ, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, সবকিছু থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার একটা চেষ্টা করা হয়েছে দীর্ঘ ২১ বছর। তাই আমি চেয়েছি, সত্যটা মানুষের জানা উচিত। এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনের এর চার খ- বই আকারে প্রকাশ হয়েছে। পঞ্চম খ- প্রকাশ হচ্ছে। মোট চৌদ্দ খ- প্রকাশ করা হবে। বাংলাদেশের যে ইতিহাস, তার বিরাট অংশ এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পাওয়া যায়।’
দেশভাগের পরপরই ভাষা নিয়ে ষঢ়যন্ত্র হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘১৯৪৭ সালে করাচিতে শিক্ষা সম্মেলন হয়, সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় যে- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। তখন থেকেই কিন্তু আন্দোলনের সূত্রপাত। তখনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসায় মিছিল নিয়ে যায় ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসে। এরপর ১৯৪৮ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা রাখেন। এরপর থেকেই গোয়েন্দারা তার নামে গোপন প্রতিবেদন লিখতে শুরু করে।’
ভাষা আন্দোলনকারীদের রক্তের ঋণের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। আমরা চাই এই গৌরবের ইতিহাস আমাদের দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম পর্যন্ত পৌঁছে যাক। এখন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে অন্য ভাষা শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে, তাই বলে নিজের ভাষাকে ভুলে যাওয়া ঠিক নয়।
’কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘মধুসূদন দত্ত ইংরেজিতে সাহিত্য চর্চা করেছিলেন, সাহেব হয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আবার নিজের ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন, ফিরে এসেছেন। নিজের ভাষা ছাড়া যে তৃপ্তি পাওয়া যায় না, তাই তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন ,‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেতে কানাডাপ্রবাসী আবদুস সালাম ও রফিকুল ইসলাম নামের যে দুজন ব্যক্তি দীর্ঘদিন প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘১৯৫২ সালের দুজন ভাষা শহীদের নামে আপনাদের নাম। আপনাদের মাধ্যমেই হয়তো ভাষা শহীদ ও দিবসের স্বীকৃতির উদ্যোগ নেওয়ার কথা ছিল।
’ নিজেদের পরিচয় নিয়ে গর্বের সঙ্গে চলার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন,‘ গত এক দশকে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়েছে, এই অগ্রযাত্রা যেনো অপ্রতিরোধ্যভাবে অব্যাহত থাকে আমরা সেটাই চাই। সেই সঙ্গে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চা ও আন্তর্জাতিকভাবে বিস্তৃতি লাভের ব্যাপারেও সক্রিয় থাকতে হবে। আমরা বাঙালি, বাঙালি হিসেবেই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে চলবো।’
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদক বিজয়ী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হাতে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারটি তুলে দেন। প্রত্যেকে একটি করে স্বর্ণপদক, সনদ এবং ২ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়।
একুশে পদক পাওয়া বিশিষ্ট ব্যাক্তিরা হলেন ভাষা আন্দোলনে মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা, শিল্পকলায় (সংগীত) ডালিয়া নওশিন, শঙ্কর রায় ও মিতা হক, শিল্পকলায় (নৃত্য) মো. গোলাম মোস্তফা খান, অভিনয়ে এস এম মহসীন, চারুকলায় শিল্পী ফরিদা জামান, মুক্তিযুদ্ধে মরহুম হাজী আক্তার সরদার, মরহুম আবদুল জব্বার ও মরহুম ডা. আ আ ম. মেসবাহহুল হক (বাচ্চু ডাক্তার), সাংবাদিকতায় জাফর ওয়াজেদ (আলী ওয়াজেদ জাফর), গবেষণায় ড. জাহাঙ্গীর আলম ও হাফেজ ক্বারী আল্লামা সৈয়দ মোহাম্মদ ছাইফুর রহমান নিজামী শাহ, শিক্ষায় অধ্যাপক বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া, অর্থনীতিতে অধ্যাপক শামসুল আলম, সমাজসেবায় সুফি মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, ভাষা ও সাহিত্যে নুরুন নবী, মরহুম সিকদার আমিনুল হক এবং বেগম নাজমুন নেসা পিয়ারি, চিকিৎসায় অধ্যাপক সায়েবা আখতার। এ ছাড়া গবেষণায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পদক পেয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট।সংস্কৃতিবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম পুরস্কারপ্রাপ্তদের সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সচিব ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল স্বাগত বক্তব্য দেন।
৫ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক বিজয়ীদের নাম ঘোষনা করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়
মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, বিদেশি কূটনীতিক, সাহিত্যিক, কবি, শিক্ষাবিদ, লেখক, সাংবাদিক, বিগত বছরে একুশে পদক বিজয়ী এবং উচ্চপদস্থ বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন একুশে পদক অনুষ্ঠানে।
-