নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রায় অর্ধশতাধিক প্রকল্প বাস্তবায়নে আশানুরূপ গতি নেই। চলতি অর্থবছরের গত সাত মাসে ওসব প্রকল্পে আর্থিক অগ্রগতি মাত্র ১৯ দশমিক ৫৪ ভাগ। অথচ গত বছরে একই সময়ে ওই হার ছিল ৩৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। টাকার অঙ্কে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৯২১ কোটি ২ লাখ টাকা। অথচ চলতি বছর প্রকল্প বাস্তবায়নে বরাদ্দ ধরা রয়েছে ৪ হাজার ৭১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। কিন্তু অবশিষ্ট ৫ মাসে বাকি অর্থ ব্যয় নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ কমানোর প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৭ মাসে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ৪৯টি প্রকল্পের মধ্যে ১০টির আর্থিক অগ্রগতি ১ শতাংশের কম। আরো ৫ প্রকল্পের অগ্রগতি ৫ শতাংশের কম। ওই ১৫টিসহ অন্যান্য প্রকল্পে কাজ কম হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের সার্বিক অগ্রগতিতে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। নৌমন্ত্রণালয়ের এডিপি (বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি) ৪ হাজার ৭১৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এখন তা সংশোধন করে বরাদ্দের আকার কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতে ৮৯৪ কোটি ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ কমিয়ে ৩ হাজার ৮১৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের চলমান ৪৯টি প্রকল্পের ৪০টি এডিপিভুক্ত ও ৯টি অধীনস্থ সংস্থার নিজস্ব তহবিলে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এডিপিভুক্ত প্রকল্পগুলোর সার্বিক অগ্রগতি ২২ দশমিক ০৫ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ২৮ দশমিক ৯৩ শতাংশ। আর সংস্থার নিজস্ব তহবিলে বাস্তবায়নাধীন ৯টি প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ; যা গত বছর ছিল ৫২ দশমিক ০৯ শতাংশ। সব মিলিয়ে গড় অগ্রগতির হার ১৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ। সংস্থাগুলোর নিজস্ব তহবিলের প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির প্রভাব নৌ মন্ত্রণালয়ের সার্বিক অগ্রগতির ওপর পড়েছে।
সূত্র আরো জানায়, অতিসম্প্রতি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সব প্রকল্পে অগ্রগতি নেই আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় বলা হয়, ১০টি প্রকল্পের অগ্রগতি এক শতাংশেরও কম। প্রকল্পগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অধীনস্থ দুটি কাটার সেকশন ড্রেজার, সহায়ক বোট ও যন্ত্রপাতি সংগ্রহ প্রকল্প (অগ্রগতি শূন্য শতাংশ) এবং দুটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাগবোট সংগ্রহ প্রকল্প ( অগ্রগতি ০.০০৪ শতাংশ)। ওই দুটি প্রকল্পই আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাছাড়া বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) অধীনস্থ ২টি প্রকল্প হচ্ছে পুরনো ডাম্প ফেরি প্রতিস্থাপনকল্পে ২টি কে-টাইপ ফেরি নির্মাণ (অগ্রগতি ০.০১৪ শতাংশ) এবং চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া-বরিশাল রুটে দক্ষ যাত্রী সার্ভিস পরিচালনার লক্ষ্যে যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণ (অগ্রগতি শূন্য শতাংশ)। ওই দুটি প্রকল্পও জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন (অগ্রগতি শূন্য শতাংশ), স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান কার্যালয় নির্মাণ প্রকল্প (অগ্রগতি ০.০৮ শতাংশ) ও বাল্লা স্থলবন্দর উন্নয়ন প্রকল্প (অগ্রগতি ০.৫৫ শতাংশ)।
সূত্র আরো জানায়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থাগুলোর মেগাপ্রকল্পে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। সেজন্য আমলাতান্ত্রিক ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় জটিলতা ও প্রতিকূল পরিবেশকে সংশ্লিষ্টরা দায়ি করছেন। তার মধ্যে একটি হচ্ছে- পায়রা সমুদ্রবন্দরের প্রথম টার্মিনাল এবং আনুষঙ্গিক সুবিধাদি নির্মাণ প্রকল্প। ৩ হাজার ৯৮২ কোটি ১০ লাখ টাকার ওই প্রকল্পে চলতি বছরে বরাদ্দ রয়েছে ২১৩ কোটি টাকা। কিন্তু জানুয়ারি পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ৬ কোটি ১২ লাখ টাকা; যা লক্ষ্যমাত্রা ২ দশমিক ১৭ শতাংশ। তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের একটি প্রকল্পের ব্যয় কমিয়ে আনায় বরাদ্দ কমে এসেছে। সংশোধিত এডিপি পাস হলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাকি ৫ মাসে ব্যয় করতে হবে ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৮১ লাখ টাকা। তবে অর্থবছরের শেষ ৫ মাসে তড়িঘড়ি করে ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে টাকার অপচয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
আরেক মেগা প্রকল্প পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা সুবিধাদি উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতি ২৪ শতাংশ। ৩ হাজার ৫০৬ কোটি ১৪ লাখ টাকার ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ৫শ’ কোটি টাকা। কিন্তু জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১১৯ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। তাছাড়া সমুদ্রে প্রতিকূল পরিবেশ ও ড্রেজিংয়ের মাটি ফেলার জায়গার অভাবে পিছিয়ে পড়েছে মোংলা বন্দর চ্যানেলের আউটার বারে ড্রেজিং প্রকল্প। ৭১২ কোটি ৫০ লাখ টাকার ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ২৯০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫৯ কোটি টাকা। বিআইডব্লিউটিসির সবচেয়ে বড় প্রকল্প ৩৫টি বাণিজ্যিক ও ৮টি সহায়ক জলযান সংগ্রহ এবং ২টি নতুন স্লিপওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ। কিন্তু ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দকৃত ১১০ কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১৩ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। ওই প্রকল্পটির শুরুত টেন্ডার ও ডিপিপি সংশোধন সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়। একইভাবে বিআইডব্লিউটিএর সবচেয়ে বড় প্রকল্পগুলোর আরেকটি হচ্ছে ৩৫ ড্রেজার ও সহায়ক জলযান আনুষঙ্গিক সরঞ্জামাদি সংগ্রহ প্রকল্প। ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রয়েছে ১২০ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। আর জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। তা ২ হাজার ৪৮ কোটি টাকার ২০টি ড্রেজারসহ সহায়ক যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি সংগ্রহ প্রকল্পে বরাদ্দ রয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যয় ৫৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা; যা লক্ষ্যমাত্রার ১৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আশুগঞ্জ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার নৌবন্দর স্থাপন প্রকল্পের অগ্রগতি ২ দশমিক ০৬ শতাংশ। ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পের বরাদ্দ রয়েছে ৬০ কোটি টাকা। আর ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। তাছাড়া আরো কয়েকটি বড় প্রকল্পের অগ্রগতি কম হয়েছে। তবে কিছু প্রকল্পের অগ্রগতি বেশিও রয়েছে।
এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণ প্রসঙ্গে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আবদুস সামাদ জানান, কয়েকটি কারণে কিছু প্রকল্পে অগ্রগতি কম হয়েছে। পদ্মাসহ কয়েকটি নদীতে বর্ষাকালে ড্রেজিং শুরু হয়নি। অনেক পরিচালক প্রকল্পের অর্থছাড় চাহিদা দেরিতে দিয়েছেন। তাছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে প্রকৌশলীর অভাব রয়েছে। তবে প্রকল্প পরিচালকদের চাপের মধ্যে রেখেছি। আশা করা যায় লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
অন্যদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নে অর্থ অপচয়ের শঙ্কা নাকচ করে দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চেšধুরী জানান, কাজ হবে না, টাকা বরাদ্দ হবে- এ ধরনের লক্ষ্য অর্জন করতে চাই না। যদিও আগের বছরের তুলনায় এবার এডিপি বাস্তবায়ন কিছুটা কম। তবে ধারণা করা যায় জুনের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।