শিক্ষা খাতে সরকারের নানামুখী উদ্যোগেও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার কমাছে না। বরং বিগত ৫ বছরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে মাধ্যমিক। ওই স্তরের জন্য একাধিক প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও মাধ্যমিকেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। আর তিন স্তরেই ছেলেদের তুলনায় বেশি ঝরে পড়ছে মেয়েরা। অবশ্য ইতিমধ্যে প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে উন্নীত হয়েছে। আর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে জেন্ডার সমতাও নিশ্চিত হয়েছে। সরকার এখন মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করায় জোর দিচ্ছে। কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ঝরে গেলে দেশের পক্ষে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো দুরূহ বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিস্তার ও উন্নয়নে সরকার বৃত্তি, উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণসহ নানা সুবিধা বাড়িয়েছে। তাছাড়া বিগত ২০১৩ সালে একযোগে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়েছে। আর গত বছর ২ হাজার ৭৩০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের আর্থিক সুবিধা, চাকরির স্থায়িত্ব ও পেশার প্রতি মর্যাদা বাড়ানো হচ্ছে। তারপরও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ, ২০১৮ সালে ১৮.৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৮.৮৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে ১৯.২ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০.৪ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২০.৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে এই ঝরে পড়ার হার ছিল ৪৫.১ শতাংশ। তারপর থেকে ৫ বছর নানা উদ্যোগের ফলে ব্যাপকভাবে ঝরে পড়া কমেছে। কিন্তু গত ৫ বছর ধরে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৩৭.৮১ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৩৮.৩০ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৪০.২৯ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৪১.৫৯ শতাংশ। অথচ ২০০৯ সালে মাধ্যমিকের ঝরে পড়ার হার ছিল ৫৫.৩১। তার পরের ৫ বছর দ্রুতগতিতে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত ৫ বছরে তা ঝিমিয়ে পড়েছে। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ২০১৮ সালে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৯.৬৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে ১৯.৮৯ শতাংশ, ২০১৬ সালে ২০.০৮ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২০.৭ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ২১.৩৭ শতাংশ। ২০০৯ সালে ওই স্তরেও ঝরে পড়ার হার ছিল ৪২.১১ শতাংশ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের মতোই পরবর্তী ৫ বছর ব্যাপকভাবে ঝরে পড়ার হার কমলেও গত ৫ বছরে প্রায় একই রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, আগের চেয়ে এদেশের মানুষ এখন আর্থিকভাবে বেশ সচ্ছল। দরিদ্র পরিবারও তার সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে চায়। তবে অতিদরিদ্রদের কথা ভিন্ন। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন আর খুব বেশি লেখাপড়া হয় না। খুব একটা চাপ না থাকায় শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক পর্যন্ত কোনো রকম উতরে যায়। তবে যারা ভালো করতে চায় বা যাদের অভিভাবকরা সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখেন তারা সাধারণত বেসরকারি স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে চলে যায়। আর মাধ্যমিকে বেশির ভাগ স্কুল এমপিওভুক্ত হলেও সেখানকার শিক্ষকরা ততোটা দক্ষ নন। তাছাড়া পাঠ্য বইয়ের বিষয়বস্তুকে দুর্বোধ্য করে রাখা হয়েছে। পাঠ্যসূচিতে এমন একাধিক বিষয় ও অধ্যায় রয়েছে যা কখনোই কাজে লাগে না। তারপর শিক্ষার্থীদের আবার দুর্বোধ্য সৃজনশীলের চাপে পড়তে হয়। এই আনন্দহীন শিক্ষায় স্কুলে শুধু পড়া দেয়া এবং নেয়া হয়। মোটকথা স্কুলে তেমন কোনো পড়ালেখাই হয় না। এমন পরিস্থিতিতে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্ন মধ্যবিত্তরাও প্রাইভেট-টিউশনি, কোচিং, সহায়ক বইয়ের মাধ্যমে স্কুলের বাইরে থেকে শিক্ষা কিনে নেয়। কিন্তু স্কুলে খুব একটা টাকা খরচ না হলেও বাইরে থেকে শিক্ষা কেনার মতো নিম্নবিত্তদের টাকা থাকে না। ফলে তারা কিছুদিন মাধ্যমিক স্তরে স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকে। একসময় আনন্দহীন এই শিক্ষা থেকে তারা ঝরে পড়ে। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরে যাওয়ার পেছনের কারণ অনেকটা মাধ্যমিকের মতোই। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েও অনেক শিক্ষার্থী পরিবারকে সহায়তার জন্য নানা কাজে যুক্ত হয়। অনেকে কারিগরি শিক্ষায় চলে যায়। আবার অনেকে শ্রমিক হিসেবে দেশের বাইরে চলে যায়।
ফলে ঝরে পড়ার হার কমছে না। এদিকে বর্তমানে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা চলছে। ২০২০ সালের এই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে ২০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৭৯ জন শিক্ষার্থী। ২০১৪ সালে এই শিক্ষার্থীরাই পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তবে তখন পরীক্ষার্থী ছিল ৩০ লাখ ৯৪ হাজার ২৬৫ জন। ওই হিসাবে ১০ লাখ ৪৬ হাজার শিক্ষার্থীর কোনো হদিস নেই। অর্থাৎ ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এই পাঁচ বছরে সাড়ে ১০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান, শিক্ষায় একটি বড় পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারিকুলামে বড় পরিবর্তন আসছে। সরকার শিক্ষাকে জীবনমুখী করতে চায়। সেজন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তাছাড়া মাধ্যমিক স্তরেও কারিগরি শিক্ষা যুক্ত করা হচ্ছে। তাতে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার পাশাপাশি হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারবে। ফলে তাদের মাধ্যমিক শিক্ষা শেষেও চাকরির নিশ্চয়তা থাকবে। তাতে ঝরে পড়ে অনেকাংশেই কমে যাবে।
এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন জানান, একটা পর্যায়ে এসে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার বেশি একটা কমে না। মূলত যারা ভালোভাবে শিক্ষা অর্জন করতে পারে না তারাই ঝরে যায়। তবে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে এই হার কমে যাবে। সেজন্য প্রাথমিকে রিডিং, রাইটিং ও ম্যাথ অলিম্পিয়াডের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আরেকটি কারণ দারিদ্র্য। অনেক পরিবার গ্রাম থেকে শহরে মাইগ্রেট করলে আর স্কুলে যায় না। তবে সরকার সব স্কুলেই স্কুল ফিডিং চালু করতে যাচ্ছে। তাতে ঝরে পড়ার হার অনেকাংশেই কমে যাবে।