শিল্প মালিকরা আমদানি পর্যায়ে পরিশোধ করা আগাম কর (এটি) যথাসময়ে ফরত পাচ্ছেন না। ভ্যাট আইনে ৬ মাসের মধ্যে রিফান্ড দেয়ার বিধান থাকলেও মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন। শিল্প মালিকরা এখনো জুলাইয়ে পরিশোধিত আগাম কর ফেরত পাননি। কারণ ভ্যাট কমিশনারেটগুলো সরকারি চেকবই পায়নি। তাতে উদ্যোক্তাদের মূলধন আটকে যাচ্ছে। ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয়ও বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সবচেয়ে বেশি জটিলতার মধ্যে পড়েছে। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় সম্প্রতি ভ্যাট রিফান্ড সংক্রান্ত সাধারণ আদেশ জারি করে এনবিআর। তাতে ভ্যাট কমিশনারেটগুলো কীভাবে চেকবই সংগ্রহ করবে এবং রিফান্ড দেবে সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এনবিআর এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নতুন ভ্যাট আইনে সব ধরনের আমদানি পণ্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে আগাম কর আরোপ করা হয়। তাতে বলা হয়েছে, করযোগ্য আমদানির ওপর ৫ শতাংশ আগাম কর আদায় করতে হবে। প্রত্যেক নিবন্ধিত আমদানিকারক নির্ধারিত পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট কর মেয়াদে মূসক দাখিলপত্রে পরিশোধিত আগাম করের সমপরিমাণ অর্থ সমন্বয় করতে পারবেন। যারা নিবন্ধিত নন, তারা কমিশনারের কাছে আগাম কর ফেরত পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন। কিন্তু ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের মতে, আইনেই বলা আছে আগাম পরিশোধের ৬ মাস পর তা ফেরত দেয়া হবে। ওই হিসাবে জুলাইয়ে আমদানির বিপরীতে যে আগাম কর পরিশোধ করা হয়েছে, তা জানুয়ারিতে ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি। আর মার্চে এসে এনবিআর রিফান্ডের জটিলতা অনুধাবন করেছে। আর আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকতার কারণে এ অর্থবছরের মধ্যে টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো লক্ষণই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা শিল্প মালিকদের বহন করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ভ্যাট আইনটি নতুন হওয়ার কারণে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বেশকিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখা দিয়েছে। সেগুলো পর্যায়ক্রমে ঠিক করা হচ্ছে। রিফান্ডের ক্ষেত্রেও কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সাধারণ আদেশ জারি করা হয়েছে। তাতেও যদি জটিলতা থাকে তাহলে পরে আরো সংশোধিত আদেশ জারি করা হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের ব্যবসায়ীদের মতে, এভাবে আগাম কর নেয়া হয়রানি ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া যদি ফেরতই দেয়া হবে, তাহলে আগাম নেয়া হবে কেন? এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান আরো পিছিয়ে পড়ছে। কারণ ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন। তার বিপরীতে মোটা অংকের সুদ গুনতে হয়। এতো বিপুল অঙ্কের টাকা সরকারের কাছে আটকে থাকার কারণে একদিকে সুদ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের মূলধন সঙ্কট পড়ছে। মূলত এক শ্রেণির নেতিবাচক আমলাদের কারণেই এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে।
সূত্র আরো জানায়, জুলাইয়ে কার্যকর হওয়া ভ্যাট আইনের বিধিমালার ৫২ বিধিতে বলা আছে, নিবন্ধিত ব্যক্তি নির্ধারিত ফরমে অর্থ ফেরতের আবেদন করতে পারবেন। আবেদন যাচাই-বাছাই করে কমিশনার আবেদনকারীর ব্যাংক হিসাবে ফেরতযোগ্য অর্থ জমা দেবেন অথবা ক্রসড চেক ইস্যু করবেন। তবে ৬ মাস পর্যন্ত পরিশোধিত কর সমন্বয় করতে হবে। এরপর অতিরিক্ত করের পরিমাণ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তা চেকের মাধ্যমে ফেরত দেয়া হবে। অথচ ৮ মাস পর গত ১ মার্চ এনবিআর থেকে এ বিষয়ে সাধারণ আদেশ জারি করা হয়। যেখানে ভ্যাট কমিশনারেটগুলো কীভাবে সরকারি হিসাব খুলবে এবং চেকবই সংগ্রহ করবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন ছিল টাকা ফেরত দেয়ার পদ্ধতি সহজ করে আইনটি কার্যকরের সময়ই পৃথক প্রজ্ঞাপন বা সার্কুলার জারি করা। বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়ছে ভ্যাট অব্যাহতিটও্প্ত দেশীয় টওাতষ্ঠানগুলো। কারণ এ জাতীয় পতিষ্ঠানকে কাঁচামাল আমদানিতে ভ্যাট-ট্যাক্সে ছাড় দেয়া আছে। অর্থাৎ আমদানি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানগুলো যেই পরিমাণ আগাম কর পরিশোধ করছে বা করবে, তা পরে সমন্বয় করার সুযোগ নেই। এ অবস্থায় ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক রিফান্ডের আদেশ জারি করতে হবে।
এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবুল কাশেম খান জানান, বাংলাদেশের রিফান্ড ব্যবস্থায় কখনোই ব্যবসায়ীরা টাকা ফেরত পায়নি। যখন নতুন ভ্যাট আইন হয়, তখনই ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আগাম কর ফেরত পাওয়ার বিষয়ে হয়রানির আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। এখন ওই ভবিষ্যদ্বাণীই সত্যি হল। আগাম কর হয়রানির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের ওপর চাপ পড়ছে। আগাম কর কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসের পরিপন্থী।
একই প্রসঙ্গে বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, বাংলাদেশে টাকা ফেরতের সিস্টেমটা খুবই জটিল। যদি টাকা নিয়ে পরে ফেরত দেয়ার নিয়ম করা হয়, তাহলে ওই টাকা নেয়ার দরকারটা কী? যেমন নিট খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলের ভ্যাট ফেরত দেয়ার বিধান আছে। কিন্তু এ টাকা ফেরত পেতে এতো হয়রানি হতে হয় যে- একপর্যায়ে ব্যবসায়ীরা হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। তাই শিল্পের স্বার্থে আগাম কর নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ বাড়ছে। আর শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা কমছে।
বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, আমদানিকৃত কাঁচামাল দিয়ে পণ্য উৎপাদনের পর তা বিক্রি করলে কত শতাংশ মুনাফা হবে, সে হিসাব করে আগেই আগাম কর নেয়া হচ্ছে। পৃথিবীর কোথাও আগাম কর নেয়া হয় না। আর যেসব শিল্প ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত সেসব শিল্প কিভাবে টাকা ফেরত নেবে? আগাম কর শিল্পের জন্য নতুন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এনবিআরের রিফান্ড প্রক্রিয়া সহজ করা দরকার।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে এনবিআরের দায়িত্বশীলরা জানান, আগামী মাস থেকেই শিল্প মালিকরা রিফান্ড পাওয়া শুরু করবেন। সাধারণ আদেশের প্রেক্ষিতে ভ্যাট কমিশনারগুলো হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্কের জন্য পৃথক পৃথক সরকারি হিসাব খুলবে। এরপর হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সরকারি চেকবই ইস্যু করলে রিফান্ড দেয়া শুরু হবে। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১৫ দিন সময় লাগতে পারে।