পুরো অর্থবছরে শতাধিক প্রকল্পে কোনো অর্থই খরচ করা হয়নি। যেসব কারণে ওসব প্রকল্পের অর্থ খরচ হয়নি তার মধ্যে অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে- অর্থছাড় না হওয়া বা দেরিতে অর্থছাড়, ভূমি অধিগ্রহণ না হওয়া, দরপত্র আহ্বানে বিলম্ব, দরপত্র রেসপনসিভ না হওয়া, প্রকল্পে ঋণ না পাওয়া এবং নামমাত্র বরাদ্দ, মামলাজনিত জটিলতা, প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন, সংশোধিত ডিপিপি অনুমোদনে বিলম্ব এবং উন্নয়ন সহযোগীর সঙ্গে চুক্তি সইয়ে বিলম্ব হওয়া ইত্যাদি। এখন এনইসি বৈঠক থেকে ওই প্রকল্পগুলোর ভবিষ্যৎ বিষয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা আসতে পারে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৮-১৯ অনেক আগেই শেষ। অথচ ১০৬টি উন্নয়ন প্রকল্পে এক টাকাও খরচ হয়নি। তার মধ্যে সরকারের নতুন উদ্যোগ ‘পল্লী জনপদ’ প্রকল্পের পাশাপাশি রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সহযোগী প্রকল্পও। সেগুলো বাস্তবায়নে ১ হাজার ১৬৭ কোটি ৯১ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদে নেয়া উদ্যোগগুলোর মধ্যে নতুন একটি উদ্যোগ ছিল ‘পল্লী জনপদ’ তৈরি। অর্থাৎ গ্রামের একটি রাস্তার দুই পাশে সমবায় ভিত্তিতে দ্বিতল বিল্ডিং তৈরি করে সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা। উদ্দেশ্য ছিল- সহজেই ও কম খরচে যাতে সব ধরনের নাগরিক সেবা পৌঁছানো যায় এবং কৃষি জমি রক্ষা করা সম্ভব হয়। সেজন্য হাতে নেয়া হয় ‘অ্যাকশন রিসার্স প্রজেক্ট অন কনস্ট্রাকশন অব কো-অপারেটিভ বেইজড মাল্টি স্টোরেড পল্লী জনপদ হাউজিং উইথ মডার্ন আরবান অ্যামিনেটিভস ফর লাভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট অব দ্য রুরাল পিপল’ শিরোনামের প্রকল্পটি। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৪২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি বাস্তবায়নের কথা। কিন্তু ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ওই প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু পুরো অর্থবছর ফুরিয়ে গেলেও এক টাকাও খরচ করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পাওয়ার ইভাক্যুয়েশন ও ইনফ্রাসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৯৮১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওই প্রকল্পের জন্য মাত্র ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছর শেষে এক পয়সাও খরচ হয়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের খুলনা-দর্শনা রেলওয়ে জংশন সেকশনে ডাবল লিংক ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৫০৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওই প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল মাত্র ২ লাখ টাকা। তাও ব্যয় হয়নি। ফলে প্রকল্পের আর্থিক অগ্রগতি শূন্য।
সূত্র আরো জানায়, আর্থিক অগ্রগতি শূন্য থাকা ১০৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- বাংলাদেশ রেলওয়ের পার্বতীপুর-কাউনিয়া সেকশনে ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণ, নবীনগর-আশুগঞ্জ সড়ক নির্মাণ, চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি হাইওয়ের হাটহাজারী থেকে রাউজান পর্যন্ত চার লেন সড়ক উন্নয়ন এবং ঢাকা-সিলেট-তামাবিল হাইওয়ের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ ও ইউটিলিটি অপসারণ প্রকল্প। কৈলাসটিলা-৯ কূপ খনন প্রকল্প, ঢাকায় তিনটি পাইকারি কিচেন মার্কেট নির্মাণ, সোনাগাজী-মীরেরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল লিংক রোডে ফেনী নদীতে ব্রিজ নির্মাণ, দুটি কাটার সেকশন ড্রেজার ক্রয় প্রকল্প, এক্সপানশন অ্যান্ড স্ট্রেংথেনিং অব পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক আন্ডার ডিপিডিসি এরিয়া, ডিপিডিসি’র আওতায় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আন্ডারগ্রাউন্ড সাবস্টেশন নির্মাণ এবং ডেসকো এলাকায় স্মার্ট প্রিপেমেন্ট মিটার স্থাপন প্রকল্প।
এদিকে বিপুলসংখ্যক উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো অর্থ খরচ না হওয়া প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক অগ্রগতি শূন্য থাকা প্রকল্পগুলোর গোড়ায় গলদ ছিল। কারণ সেগুলো প্রস্তুত না হলেও তাড়াহুড়ো করে এডিপিতে ঢুকিয়ে অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। যেহেতু একটি অর্থবছরজুড়ে এক পয়সাও ব্যয় করতে পারেনি, তাই পরে অবশ্যই মেয়াদ ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কথা। তাহলে প্রকল্পের সুফল তো সময়মতো মিললই না, তার ওপর জনগণের ঘাড়ে বাড়তি টাকার বোঝা চাপানো হল। এটা অবশ্যই অপচয়। সেই সঙ্গে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। সেজন্য প্রকল্পভিত্তিক কারণ খুঁজে বের করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া উচিত।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়েজ উল্লাহ জানান, নির্বাচনের আগে যেসব প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে। ওসব প্রকল্পে অর্থ ব্যয় না হওয়ার পেছনে নানা কারণ থাকে। আইএমইডি প্রতিবেদনে কিছু কারণ তুলে ধরা হয়েছে। তবে প্রকল্পগুলোর বরাদ্দ খরচ বাড়াতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে চিঠি দেয়া হয়েছে। যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলো দ্রুত সমাধান করে বাস্তবায়নের গতি বাড়ানো যায়।