বিশ্বে এখন আতঙ্কের নাম কোভিড-১৯ ভাইরাস। চীন থেকে শুরু। তারপর একে একে করোনা ভাইরাস এখন প্রায় দুইশো দেশে ছড়িয়ে পরেছে। বিশ^জুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পরার শঙ্কা তৈরি হওয়ায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করেছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। এটি এখন মহামারী রুপ নিয়েছে। বাংলাদেশেও করোনা আক্রান্ত রোগী বাড়ছে। মৃত্যুও হয়েছে। ইতিমধ্যেই করোনা রাজনীতি,অর্থনীতিসহ সব অঙ্গণেই স্থবির করে দিয়েছে। কিন্তু কোথায় গিয়ে এর শেষ হবে তা বলা যাচ্ছে না। কারণ এক দেশে এর প্রভাব কমলে অন্যদেশে তা বাড়ছে। সবচেয়ে বড় শংকা তৈরি হয়েছে অর্থনীতিতে। বলা যায়, এটি প্রায় থমকে দাড়িয়েছে। বৈশি^ক প্রবৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক চীন, আমেরিকা ও ইউরোপজুড়ে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস অর্থনীতিতে ধ্বস নামিয়েছে। দোকানপাঠ,বিমান চলাচল সব বন্ধ থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে নিরাপত্তাই মুখ্য সেখানে এর থেকে ভালো উপায় হয় না। এর ফলে আর্থিক বিশ^মন্দার বাস্তবে রুপ নিতে শুরু করেছে বলে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদরা। এর মধ্যে চীনের তথ্য বেশি দুশ্চিন্তার কারণ। ১৯৮৯ সাল জিডিপির প্রান্তিক তথ্য প্রকাশ শুরুর পর প্রথম ধসের মধ্যে পড়লো বিশে^র দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ বোর্ডের গবেষণা ও পরিসংখ্যান বিবাগের সাবেক প্রধান ডেভিড উইলকক্স সিএনএন বিজনেসকে বলেন, ১০ দিন আগেও বিশ^ অর্থনীতি মন্দার দিকে মোড় নিচ্ছে কিনা তা নিয়ে বাস্তব অনিশ্চয়তা ছিল, কিন্তু এখন এটি নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন নেই। অর্থনীতির আর একটি দিক চাকরির বাজার। করোনার কারণে এই দিকেও টালমাটাল অবস্থার তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও এর মতে, মহামারি রুপে ছড়িয়ে পরা নতুন করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ চাকরি হারাতে পারে। আইএলও এর মতে, নতুন করোনা ভাইরাসটির প্রভব যদি খুব স্বল্পমাত্রায় হয় তাহলে অন্তত ৮০ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারে। আর এর মাত্রা যদি খুব বেশি হয় তাহলে বেকার হওয়া মানুষের সংখ্যা দাড়াবে ২ কোটি ৪৭ লাখ। এখানে উল্লেখ্য যে, ২০০৮-০৯ কালীন সময়ে বৈশি^ক আর্থিক সংকটের সময়ে বেকার হয়েছিল ২ কোটি ২০ লাখ মানুষ। তবে এর সাথে আইএলও আরও বলছে, ২০০৮ সালের বৈশি^ক মন্দার সময়কার মতো বিশ^জুড়ে সমণি¦ত উদ্যোগ নেয়া হলে সম্ভাব্য বেকারত্বের হার অনেক কম হতে পারে।
একটি বিষয় হলো অর্থনীতি এবং শ্রমবাজার একে অপরের সাথে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই ভবিষ্যত একটি দিকে ইঙ্গিত করে। তাহলো যদি এর প্রভাব আরও তীব্র হয় তাহলে বৈশি^ক মন্দার ভেতর পরতে হবে। আর তা যদি আমরা সামাল দিতে চাই তাহলে সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূণ হলো অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করা। ্এদিকে এই ভাইরাসে আক্রান্তের হার এখন ইতালি,ইরান ইত্যাদি দেশে বেশি। এন্টার্টিকা বাদে পৃথিবীর বাকি সব মহাদেশেই ছড়িয়ে পরেছে এই ভাইরাস। প্রতিদিন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে। চীনের অবস্থা সবচেয়ে বেশি সংকটজনক ছিল। এখন তা স্থিতিশীল। উহানের সেই ডাক্তার যারা বীরের মতো পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে তারা আজ আদর্শ। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য চীনসহ সারা বিশ^ই আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তারা এখন এগিয়ে আসছে অন্যদের সাহায্য করতে। তাদের সাহায্য আমাদের কাজে লাগবে। কারণ তারা ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে। প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। বলা যায় প্রাণাহানি এবং অর্থনীতি দুই দিকেই ক্ষতি করে চলেছে এই ভাইরাসের প্রকোপ। বিশ^ব্যাপী ক্রমেই ভয়াবহ রুপ নিচ্ছে করোনা ভাইরাস। আশা করা হচ্ছিল এর প্রভাব ক্রমেই কমতে থাকবে এবং একসময় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। তবে সেটি না হয়ে আরও বহু দেশে ছড়িয়ে পরছে। কেবল আমাদের দেশের অর্থনীতি নয় বরং বিশে^র অর্থনীতি গতিকেই খানিকটা স্লথ করে দিয়েছে করোনা বা কোভিড-১৯। পরিস্থিতি যদি দ্রুত স্বাভাবিক না হয় তাহলে তা অর্থনীতিকে ক্ষতির মুখে ফেলবে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রকৃতপক্ষে এমন একটি বিষয় যেখানে এক দেশ অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। তা যদি চীনের মতো শক্তিশালী বাণিজ্য সক্ষমতাসম্পন্ন দেশ হয় তাহলে তা আরও বেশি প্রভাব ফেলবে এটাই স্বাভাবিক। নিত্য নতুন প্রযুক্তি পণ্যে খুব দ্রুত বিশে^ নিজের অবস্থান সুসংহত করে নেয়া দেশ হলো চীন। যার প্রযুক্তি পণ্য বিশে^ অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহারের একটি বড় অংশ পূরণ করছে। তা সে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই। করোনা ভাইরাসের প্রভাব কতদিন চলবে বা তার প্রভাব কতটা তীব্র হবে তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অনেক দেশেই তা ছড়িয়ে পরেছে। ধীরে হলে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পরছে। বর্তমান সময়ে চীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বিশে^ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের বাজারে চীনা পণ্য অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিছু পণ্য প্রায় এককভাবে রয়েছে চীনের দখলে। ব্যবসা বাণিজ্যে চীনকে সর্বাধিক গুরুত্বে তালিকায় রাখে অনেক দেশ। এজন্য চীনকে ’সব দেশের কারখানা’ বলেও অভিহিত করা হয়। বিশ^ থেকে চীনের যোগাযাগ অনেকটাই সীমিত হয়ে গেছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশেও আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও দ্রব্যের শতকরা ৮০ ভাগেরও যোগানদাতা চীন। আমদানি ও রপ্তানির বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, চীন থেকে পণ্য আনা ব্যহত হওয়ায় ইতিমধ্যে প্রধান রপ্তানি পণ্য গার্মেন্টেসের এক্সেসরিজের দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানিয়েছে এ খাতের শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। কিছু পণ্যে বেশি আবার কিছু পণ্যে কম প্রভাব পরবে। আবার সময়ের সাথে সাথে কিছু পণ্যের চাহিদা তীব্র হবে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। এই পরিস্থিতিদ সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে সমস্যাটি কত দীর্ঘ হয়। যদি দ্রুতই এর সমাধান হয় তাহলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু তা না হলে অর্থনীতিতে বিশ^ মন্দা দেখা দিতে পারে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা রয়েছে। তবে সেটাও নির্ভর করবে এর প্রভাব ঠিক কতদিন চলবে এবং তীব্র হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন করেনার ফলে দেশে হাজার হাজার মানুষ কর্ম হারাবে। বন্ধ রয়েছে পর্যটন কেন্দ্রগুলো। ফলে সেই খাতের বিপুল অর্থ আসার পথ আপাতত বন্ধ। এ অবস্থা কতদিন চলবে বলা যাচ্ছে না। এছাড়া প্রবাসীরা দেশে ফিরে আসছেন। তাদের পাঠানো অর্থ থেকে যে আয় হতো তাও কমে আসছে। হোটেল এবং পরিবহন খাতেও আয় কমেছে সঙ্গত কারণেই। মূলত আর্থিক একটি খাত অপর খাতের সাথে ওতোপ্রতোভাবে সম্পর্কযুক্ত। একটির ক্ষতি অপরটিকেও স্পর্শ করে। করোনা আতঙ্ক ছড়িয়ে পরার পর থেকে বন্ধ রয়েছে আমদানি-রপ্তানি। সেক্ষেত্রে তা কিভাবে মোকাবেলা করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাংলাদেশের যেসব খাত বাণিজ্যে চীনের সাথে সম্পর্কযুক্ত সেখানে প্রভাব পরছে। চীনের সাথে আমাদের বাণিজ্য বহু পন্যে। কিছু পণ্যের সমস্যা প্রভাব এখনই পরতে শুরু করেছে এবং কিছু প্রভাব পরবে যদি করোনা সমস্যাটি দীর্ঘ হয়। কারণ করোনা ভাইরাসের কারণে সেখান থেকে পণ্য পাঠানোর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আমাদের গার্মেন্টস পণ্যের এক্সেসরিজ খাতের কাঁচামালের অর্ধেকই আসে চীন থেকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, করোনা ভাইরাসজনিত সমস্যার কারণে দেশটি থেকে এক্সেসরিজের কাঁচামালসহ অন্যান্য পণ্য আসার ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন মাস দেরি হলে উদ্যোক্তাদের আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা। যার প্রভাব কিছুটা পরতে শুরু করেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে আন্তর্জাতিক পণ্যের বাজারও প্রভাব পরতে শুরু করেছে। আন্তর্জাতিক তেলের বাজারেও পরেছে প্রভাব। বিভিন্ন দেশের অর্থনীতির গতি কমে এসেছে। ফলে দেশগুলো জ¦ালানি তেলের চাহিদা কমিয়ে দিচ্ছে। এরই মধ্যে তেল উৎপাদক দেশগুলোর সংগঠন সিদ্ধান্ত নিয়েছে তেল উৎপাদন কমানোর বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে চিন্তা কেবল বাংলাদেশের নয় বরং সারা বিশ^কেই বিষয়টি ভাবাচ্ছে। কারণ কেবল আক্রান্ত বা মৃত্যু নয়। বরং এর ফলে অর্থনীতির চাকার কিছুটা ধীরতা এবং দীর্ঘায়িত হলে তার পরিণতি কি হবে তা নিয়েও চিন্তা রয়েছে। এক তথ্যে জানা যায়, চীনের সাথে বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি আসে সেখান থেকে। এ খাত ছাড়া বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড়ো বাজার এখন চীন। করোনার প্রভাবে এ খাতেও চলছে এক ধরনের স্থবির অবস্থা।
আমাদের অর্থনীতির একটি বড় শক্তি হলো গার্মেন্টস খাত। পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভর কর্মসংস্থানের একটি বিশাল অংশ। সম্ভাবনাময় এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়া এই খাতে রপ্তানি করে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মধ্যে বেশির ভাগই পোশাক। চীনে করোনার প্রভাবের কারণে রপ্তানিতে প্রভাব পরেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যেন কোনোভাবেই এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাজার অস্থিতিশীল না করতে পারে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেক্ষেত্রে এই সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয় তাহলে ভোগ্যপণ্যে বিকল্প বাজার খোঁজা প্রয়োজন। যাতে সরবরাহের ঘাটতির অজুহাতে বাজারে মূল্য বৃদ্ধি না হয়। সামনে পবিত্র রমজান। এই মাসকে সামনে রেখে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি একটি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থা বজায় রাখতে হলে অর্থনীতির এই গতি বজায় রাখতে হবে। করোনার প্রভাবে অর্থনীতির গতি ধীর হওয়ার অবস্থা রুখতে রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্যতার ওপরও জোর দিতে হবে। তবে এ ধাক্কা কেবল একদিক থেকে আসবে না। প্রয্ুিক্ত পণ্য,গার্মেন্টস পণ্য,নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, এমনকি যোগাযোগ ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পরবে। সমস্যা দীর্ঘ হওয়ার সাথে সাথে এবং নতুন দেশে ছড়িয়ে পরার সাথে সাথে এই উদ্বেগ আরো কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। বিশ^ করোনার ভাইরাসের মোকাবেলায় আরো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেরি করলে অর্থনীতিতে ভয়াবহ মন্দার পথেই যাবে। এবং সেক্ষেত্রে আমাদের হাতে সেই সময়কার মতো সমণি¦ত উদ্যোগ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই।
অলোক আচার্য শিক্ষক ও কলামিষ্ট